১৮ মার্চ, ২০১৩

ক্ষমা করে দিলাম


ক'দিন ধরে চলে যাবার কথা মনে হচ্ছে খুব। মনে পড়লো, যে স্কুল-কলেজের ডেস্কগুলোতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যেত, যেই গাছের নিচে বসে কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্য ছুঁয়েছিলাম, তাকে ফেলে রেখে এসেছি অনেকদিন হলো; জানিও না কী অবস্থায় আছে, কেমন আছে সেখানকার মানুষগুলো যারা আমাকে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। তৃষ্ণার্ত ছিলাম বলে এক বৃদ্ধ কর্মচারী চাচা কষ্ট করে কলস থেকে পানি ঢেলে দিয়েছিলেন-- এমন একটা ঋণও শুধতে পারব না, কেননা তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ইতোমধ্যে। ভার্সিটিতে পরীক্ষার মাঝে একবার জ্বরগ্রস্ত হয়ে কাতর হয়ে পড়েছিলাম। রুমের কেউ ভ্রূক্ষেপ না করলেও অন্য ফ্লোর থেকে এক বন্ধু এসে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছিলো। আমি কাতর হয়ে আল্লাহর কাছে চেয়েছিলাম সুস্থতা -- মাত্র দেড়দিনের মাথায় উঠেও দাঁড়িয়েছিলাম।

এরপর অজস্রবার দু'আ করেছিলাম যেন এমন রোগে না পড়ি যাতে অন্য কারো দ্বারস্থ হতে হয়। খেয়াল করলাম, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার দু'আ শুনেছিলেন, এরপরে অসুস্থতায় বিছানায় পড়লেও কারো কাছে সাহায্য চাইতে হয়নি। আমি সেই বন্ধুটার ঋণও শুধতে পারব না জানি, তার দ্বীনদারী অসম্ভব সুন্দর...এর বিপরীতে আছে অনেকজন যারা গায়ে পড়ে এসে ক্ষতি করেছে, করতে চেয়েছে। কখনো তাদের কারণে উদ্ভুত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আমার বছর পেরিয়ে গেছে। চলে যাবার কথা মনে হতে ভাবছিলাম, আমি চলে গেলে ওদের কীইবা লাভ হবে? ওরা তেমন কি কিছু পেল আমার কারণে? পাবে কি আল্লাহর কাছে যন্ত্রণা ছাড়া কিছু? অথচ আমি তো আটকে থাকিনি, কোনরকমে হলেও সুন্দর দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। অনন্তকালের একটা যাত্রার অল্প ক'দিনের ভ্রমণে আছি এখানে, এত 'স্ট্যাটাস' গায়ে মেখে কীইবা লাভ?

আমি আজ সেই ক্ষতিকারী মানুষদের ক্ষমা করে দিচ্ছি। তাদেরকে দেখলে, তাদের কথা শুনলে চাইনা আমার মাঝে খারাপলাগা বোধ হোক। তাদের ভার আমি সেই মহান সত্ত্বার হাতেই তুলে দিলাম, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক, যার বিচার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এবং নিপুণ। তোমাদের সাথে দেখা হলে আমি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে সত্য শেখাতে চাই-- এখনকার যোগ্যতায় হয়ত সেইটা পারব না, কিন্তু জেনে রেখো তোমরা যখন 'অনেক সুখে' থাকবে, তখনো আমি করুণা অনুভব করব ইনশাআল্লাহ। আমি জানি, আল্লাহর বিচার হবে কঠিন। আমি তোমাদের প্রতি রাগ জমিয়ে রাখব না, আমি যাবার বেলায় এমন অন্তরকে নিয়ে যেতে চাই যা নির্ভার। তোমাদের প্রতি রাগ আমার হৃদয়কে কেবল ভারী করে রাখে।

উপকারী মানুষদের উপকারের ঋণ শুধতে পারিনা তাই বারবারই অনুভব হয়, আরেকটা সুযোগ থাকতেই হবে, যেখানে এই ব্যাপারটা সমান হবে, যখন এই মানুষ তার প্রাপ্তি পাবে। পশুতূল্য মানুষদের অত্যাচার আর গঞ্জনা দেখলে-শুনলেও আমার একই অনুভূতি হয়-- আরেকটা সময় আসতেই হবে যখন তাদেরকে পাইপাই করে বুঝিয়ে দেয়া হবে তাদের বিনিময়। আর এই সবই করবেন সেই রাহমান, গাফুরুর রাহীম, কাহহার, কারীম যিনি এই তুচ্ছ অসহায় করে আমাকেও সৃষ্টি করেছেন, যিনি এমন মানুষদের সৃষ্টি করেছেন যারা আমার মুখ চেপে ধরতে পারবে, হাত-মুখ বেঁধে ফেলতে পারবে, বদ্ধঘরে আটকে রেখে আমাকে বঞ্চিত করতে পারলেও আমার হৃদয়ের গভীরে উচ্চারিত 'ইয়া রহমানুর রাহীম, ইয়া রব্বুল আলামীন, ইয়া হাইয়্যূ ইয়া কাইয়্যুম' নামের তরঙ্গ রোধ করতে পারবে না। অসহায় দুর্বলের চোখের অশ্রু সেই স্রষ্টার পদতলে ঠিকই স্পর্শ করবে যা পর্বতসমান অহংকারী ও ক্ষমতাধররাও রুধতে পারবে না।

হে রাহমান, আমার যাবার বেলা যেন তোমার পছন্দমতন হয়, তোমার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে যেন এই দুনিয়া ছাড়তে পারি... তাহলে এই দুর্বলতা ও অসহায়ত্বে আমার কোন দুঃখ নেই।

১৮ মার্চ ২০১৩