১৯ এপ্রি, ২০২০

মনের জানালা মাঝে # ৬০


(৫১২)
শবে বরাত বিদাত কিনা সেইটা নিয়া নানান রকমের আলাপ-আলোচনা থাকলেও হালুয়া খাওয়া যে বিদাত না সেইটা নিয়া উলামারা একমত। যত খুশি হালুয়া খান!

(৫১৩)
বিদায় তো তারই সুন্দর হয়, যার অবস্থান থাকে অর্থপূর্ণ। সুন্দর বিদায় মানে কি আর আড়ম্বর, জাঁকজমক, ঢাকঢোল? সুন্দর বিদায় হলো যতটুকু থাকা হলো, ততটুকুতে নিজ জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া, রবের স্মরণ, ভালোবাসার মানুষদের অশ্রু। চাইলেই কি আর যাবার আয়োজন সুন্দর করতে পারে সবাই? সে তো তারই হয়, যার কাজ হয় সুন্দর।

(৫১৪)
যে মানুষটির কথা ভাবলে মনে হতো, তিনি এই দেশের মুসলিম সমাজের তীব্র মতপার্থক্যের ফলে সৃষ্ট অরাজকতাকে কমিয়ে একীভূত করবেন -- সেই মানুষটি আমাদের বড্ড অসহায় করে ফেলে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর একজন ব্যতিক্রমধর্মী আলেম ছিলেন। আল্লাহ তার এই বান্দাকে যেন জান্নাতের পেয়ালার পানি করান। আমরা একের পর এক মহান মানুষদের হারিয়ে ফেলছি নানান ভাবে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। [১১ মে, ২০১৬]

(৫১৫)
তবু পৃথিবীতে ভালোবাসা রয়ে যাবে।
হয়ত কেউ জীবনের যন্ত্রণায়, রোগের দংশনে বিদায় নেবে জগতসংসার ছেড়ে রবের কাছে, কেউ তারে বিদায় দিয়ে পড়ে থাকবে আমৃত্যু যুদ্ধে। এই কষ্টকর বৃত্তে তবু ভালোবাসা জয়ী হয়। রক্ত-জ্বালা-যন্ত্রণা-শংকা পেরিয়ে মানব হৃদয় প্রেমে ডুবে।

ভালোবাসুন পৃথিবীবাসীকে। দয়াময় আল্লাহ আপনায় ভালোবাসবেন। এ জগত পেরিয়ে অনন্ত জগতে পাবেন আনন্দভরা অভ্যর্থনা! ভালোবাসা-দয়া বৃথা যায় না...

(৫১৬)
করোনাভাইরাসের প্রকোপে হঠাৎ চোখের সামনে অনেক অন্যায় দেখতে পাচ্ছি স্পষ্টভাবে, পুরোনো অন্যায়ের বীজ থেকে মহীরুহ হবার কিছু দৃষ্টান্ত। কষ্ট লাগে, খারাপ লাগে, অসহায়ও লাগে। কিন্তু মনে রাখা উচিত কি নয় যে এত এত সৃষ্টি, ধ্বংস, সভ্যতা-সংস্কৃতি, রাজত্ব-বিচার, শক্তি ও প্রতাপ এগুলো একদমই মানুষের ব্যক্তি যোগ্যতা না। একদমই 'কিছু সংখ্যক' লোকেরও অর্জন না। কারোই কোনো শক্তি নাই, কারোই কোনো 'যোগ্যতা' দিয়ে কিছু ঘটে যায় না।

জীবনে দেখলাম এত অসাধারণ মানুষগুলো, কী অবহেলায় খরচ হয়ে গেলো। এত নিকৃষ্ট মানুষগুলো, কত ক্ষমতা-অর্থ কব্জা করে দাপুটে সময় কাটালো। অথচ, আগের মানুষদের একজনের তুলনায় এরা লক্ষ-কোটিজন একত্রিত হলেও কোন মূল্যই নেই। এই বিচারও দেখার সময় এই জগত না, এর পরের একটা জগত আছে, সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার হয়। আমরা হয়ত চোখে সেটাই দেখবো, যেগুলা আপাত ক্ষমতা, ষড়যন্ত্র, লড়াই দিয়ে লোকে জিতবে। কিন্তু এরাও খুব খুব অল্প সময়েই শেষ হয়ে যাবে।

কে থাকে দীর্ঘ সময়? কেউ না। হয়ত আমরা চাই, আমাদের চাওয়ার মতন করে 'অন্যায়ের ধ্বংস' হোক। কিন্তু আল্লাহ ত সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়েছেন। তিনিই পরম ক্ষমতাবান। আর কেউ নেই। এই মহামারীর সময়ে অসহায়ত্বের এই গূঢ়তম উপলব্ধি হয়ত আমাদের প্রতি রবের পক্ষ থেকে উপহার। দিনশেষে যেকোনো উপায়েই হোক, আমরা মাটিতেই মিশে যাবো। যে যা করবো, তা সাথে নিয়ে যাবো...

১৮ এপ্রিল, ২০২০
ঢাকা, বাংলাদেশ।

ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের সাথে যে আচরণ অবশ্যই পরিতাজ্য

আমরা মুসলিমরা পারস্পরিক দ্বীনের কথা, উপকারী কথা স্মরণ করিয়ে দিবো, এটা ঈমানেরই একটা দাবি। এই কাজটা হয় আল্লাহকে ভালোবেসে, অপরকে ভালোবেসে। আমরা জানি আল্লাহই সকল হিদায়াতের মালিক, তিনি সুন্দর, তিনি কোমলচিত্ত। তাই, কাউকে উপদেশ দিতে হলে সেটা হবে ভালোবেসে। যাকে চিনিনা, এমন কাউকে অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিত উপদেশ দেয়াও উচিত নয়; তা করতে হয় প্রজ্ঞার সাথে। তবে যাদের আমরা চিনি, জানি, ভালোবাসি, তাদের যদি আমরা দেখি বিষণ্ন, দুঃখে জর্জরিত, তখন সচেতনভাবেই পাশে থাকা উচিত। তাকে এমন কথা বলা উচিত নয় যাতে সে আহত হয়। বরং বুদ্ধিমত্তার সাথে, ভালোবেসেই কথা বলতে হবে যে জিনিসটায় তার উপকার হয়। মানুষ অনেক সময় উপদেশ ছাড়াই কাছের মানুষদের সান্নিধ্যে পেলেই সঠিক বুঝ পেয়ে যায়, অনেক সময় তাদের হয়ত বকা দিতে হয়। এই ব্যালান্সটা তখনই সম্ভব, যখন আমরা ওই মানুষটাকে জানবো ও ভালোবাসবো।

তবে কেউ যখন ডিপ্রেসড থাকে, তার অবস্থা আসলে তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না বলেই সে ডিপ্রেশনে ভুগে। সচেতনভাবেই তাদের পাশে থাকতে হবে, উপদেশও খেয়াল করে দেয়া উচিত। অন্তত এমন কথা বলা উচিত নয় যা হয়ত তাকে আরো আহত করবে। সচরাচর যে বিষয়গুলো সহজেই একজন ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষকে আমরা বলে ফেলি কিন্তু সেগুলো তাকে কষ্টও দিতে পারে এমন বিষয়গুলো হলো--




১) "জীবনের ভালো বিষয়গুলোর দিকে দেখো" 

- আসলে সে তো ভালো দিক ত সে দেখতে পাচ্ছে না বলেই সে বিষণ্ণ, ডিপ্রেসড। এভাবে বললে হয়ত তাকে অন্যায়ভাবে জাজ করা হয়ে যেতে পারে। সে মনে করতে পারে সে জীবনের ভালো দিকগুলো দেখতে পায় না, সে আসলে অকৃতজ্ঞ। এই ইঙ্গিতে সে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে। আমরা এই উপদেশগুলো মানুষটিকে বুঝে তবেই দিবো...

২) "সবর করো, ধৈর্য ধরো!" 

- কেউ যদি ডিপ্রেসড থাকে, তাকে যদি বলতে থাকা হয় যে "ধৈর্য ধরো... ধৈর্য ধরো"-- অনেক সময়েই এটা এক ধরনের জাজমেন্ট করা হয়। এতে করে বলেই দেয়া হচ্ছে ইঙ্গিতে যে সে সবর করছে না, যে আসলে ধৈর্যহীন। হয়ত তার এখন এই কথাটা শোনা প্রয়োজন নেই, বরং যে কথা শুনলে, তার আল্লাহর উপরে, নিজের উপরে আস্থা বৃদ্ধি পাবে এমন কথা বললে সে হয়ত আপনাতেই ধৈর্যধারণ করবে আল্লাহর কাছ থেকে বিনিময় পাওয়ার আশায়...

৩) "এই দোয়া পড়ো, ঐ দোয়া পড়ো..." 

- দু'আ করলে, আল্লাহর স্মরণ করলে তা অবশ্যই মানুষের হৃদয়কে প্রশান্ত করে, মনের শান্তির কারণ হয়। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন "যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।" [১]। কিন্তু কেউ যখন ডিপ্রেসড, তাকে গিয়ে যদি আমরা বলে ফেলি যে, "এই দোয়া পড়ো, ঐ দোয়া পড়ো..." তাতে হয়ত একটা জাজমেন্ট স্পষ্ট থাকে যে আসলে ডিপ্রেসড ব্যক্তি দোয়া পড়ে না। এতটুকু জ্ঞানও হয়ত তার নাই! আল্লাহ তো অন্তরের কথাই জানেন, একদম দোয়ার শব্দই তো লাগে না, তাইনা? এটা আমরা জেনে বুঝেই যদি তার প্রতি সহমর্মী হয়ে আরো উপকারী পদ্ধতি হিসেবে দোয়ার কিছু একটা সামনে রেখে দিই, আল্লাহ জানেন, হয়ত নিজে থেকেই সে আগ্রহী হয়ে আল্লাহর কাছে আরবি দোয়াগুলো দিয়েই চাইবে। কিন্তু আমাদের আচরণ হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ ও ভালোবাসাপূর্ণ।

8)"আরেহ, বাদ দাও এইসব ডিপ্রেশন, এগুলা কোনো ব্যাপারই নাহ.." 

- এই কথা বলা খুব বাজে একটা কাজ। যে মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগেনি সে ভাবতেও পারে না এর অনুভূতিটা কেমন। এখনকার সামাজিক জীবনে এটা নানানভাবে লোকজনকে আঁকড়ে ধরে। তবে ঈমানদারগণ ইনশাআল্লাহ সহজেই বেরিয়ে আসতে পারবে। এই বিশ্বাস নিজে রেখে অপর ভাই/বোনের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে উদারতার হাত বাড়িয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু এসব অনুভূতিগুলোকে যখন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে বলা হয়, তখন সে এতে সংকুচিত হয়ে যাবে, আরো খারাপ ফিল করবে, অপমানিত অনুভব করবে। আমরা হয়ত তাকে আরো সুন্দর কোনো কাজে তার সংগী করে নিতে পারি যাতে লোকের উপকার আছে, যেখানে ব্যস্ত হয়ে সে বিষণ্ণ অনুভূতিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগ পাবে না।

৫) "তোমার চেয়েও লোকে অনেক খারাপ অবস্থায় আছে ..."

- এই ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে খুব প্রচলিত। হয়ত যখন তখন অসাবধান হয়ে অন্যকে আমরা বলে বসি, "দেখো তুমি এটুকুতেই এরকম মন খারাপ, ওই যে দেখো ইয়েমেনের লোকেরা না খেয়ে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে হলেও ভালো থাকো।" -- এটা ঠিক নয়। ইয়েমেনের শিশুরা খেতে পারছে না, এটা খুবই বড় সত্য। কিন্তু তার মানে তো এটা না যে আমাদের জীবনের কষ্টগুলো মিথ্যে। বরং, অপরের দিকে ভালোবাসা আমাদের নিজেদেরকেও ভালোবাসার পথ সুগম করে দেয়। পরোপকার করতে চাওয়ার ইচ্ছে আমাদের অন্তরকে উদার করে দেয়, ঈমানকে বাড়িয়ে দেয়। তাই এমনভাবে না বলে বরং মানুষটি যেভাবে নিজের কষ্টকে ভুলে ভালো কাজে উৎসাহী হবে, আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে জীবনের কাজে ব্যস্ত হবে এমন কিছু বলা উচিত।

মোটকথা, সচেতনভাবে মানুষের সাথে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে হবে। অনেকসময় আমাদের অনেকের কেবল প্রয়োজন হয় ভালোবাসা, সহমর্মিতা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদেরকে উত্তম আখলাক দান করুন, দ্বীনের উত্তম বুঝ দান করুন, আমাদেরকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।

রেফারেন্সঃ
[১] সূরা আর-রাদ, আয়াত ২৮ http://tanzil.net/#trans/bn.bengali/13:28
[২] শেইখ আজহার নাসেরের আলোচনা শুনুনঃ https://www.youtube.com/watch?v=MPhYITkCJ_0

মনের জানালা মাঝে # ৫৯



(৫০৮)
আপনার চোখগুলো যা দেখতে চায়, আপনি তো কেবল সেটাই দেখতে পান।

মূল দেখার বস্তুগুলো আমাদের কন্ট্রোলের বাইরে, আল্লাহ যা চান, সেটাই হয়। তাই, ঘটনাগুলো দেখতেই হয়। কিন্তু ঘটনা তো প্রতি মূহুর্তেই আমাদেরই চারপাশে অজস্র। ফ্যান ঘুরলে কাপড় নড়ে, বাইরে পাখি ডাকে, কেউ কাউকে কিছু বলতেসে, এমন হাজারো ঘটনা। এগুলোর মাঝে আমরা যেটা চাই, সেটাই কেবল খেয়াল করি। আর যা খেয়াল করি, তাকে নিজেদের ইচ্ছেমতন ব্যাখ্যা করি। রাস্তায় কেউ কাউকে থাপ্পড় দিলো-- এই দৃশ্য দেখে আপনি ভাবতে পারবেন এটা অন্যায়, ভাবতে পারবেন দুর্বলদের উপরে সবলের অত্যাচার, ভাবতে পারবেন এটা বড় ভাই ছোট ভাইকে শাসন করেছে। ঘটনা যাই হোক, যে অনুভূতি আপনি পেতে চান, আপনি নিজেকে সেটাই বিশ্বাস করান, ঘটনা তখন তেমনটিই মনে হয়।

[২৪ এপ্রিল, ২০১৬]

(৫০৯)
সচরাচর আমাদের হাসি থাকে মৃদু, উচ্চস্বরে নয়। সেটাই উত্তম। কিন্তু মাঝে মাঝে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হয়, মাঝে মাঝে হিহিহি করে, আবার কখনো হোহোহো করেও হাসতে হয়। কখনো হাসি হবে মুচকি, কখনো নিঃশব্দে দাঁত বের করেও হাসা উচিত। হৃদয়কে বৈচিত্র্য দিয়ে আনন্দ দেয়া উচিত, তাহলে মানুষটার ব্যক্তিত্বের মাঝেও আনন্দময় ভিন্নতা তৈরি হতে পারে।

যে প্রাণখুলে হাসতে জানে না, তার প্রাণের উচ্ছ্বলতা প্রকৃতপক্ষে মরেই থাকে। হাসিতে থাকে আমাদের হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি।

(৫১০)
শাইখ হামজা ইউসুফ হ্যানসনের আব্বা মারা গেছেন ক'দিন আগে, পৃথিবীর অনেক স্কলাররাই তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করছেন, দোয়া জানিয়ে। ৮৯ বছর বয়সে এসে তিনি মৃত্যুর কিছুকাল আগে কালেমা শাহাদাত পাঠ করেন। কী সুন্দর বিদায়! যার ছেলে সবাইকে ভালোবেসে গিয়েছে, শেখায় উদারতা, সহমর্মিতা আর জ্ঞানের গভীরতা; তার পিতা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পাবেন-- এটাই তো স্বাভাবিক। আল্লাহ হামজা ইউসুফের পিতাকে জান্নাতবাসী করুন এবং আমাদের উত্তম, সহজ, ঈমানী মৃত্যু দান করুন।
[১৯ এপ্রিল, ২০১৬]