৫ ডিসে, ২০১০

ঔদাসিন্যে চিন্তাবিদ্ধ এইসব দিনরাত্রি

অদ্ভূত সব দিন কেটে যাচ্ছে। ক্রমাগত... ইদানিং একদম লিখতে ইচ্ছে করেনা।  একটা তীব্র অনিচ্ছা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। একটা তীব্র অনাগ্রহ আমাকে ক্রমাগত উদাসীন করে চলেছে সবকিছুর প্রতি... তারই একটা ধকল হয়ত 'না লেখালেখি'। অথচ কিছু ভাবনা যে আমাকে যন্ত্রণাদগ্ধ করেনা, তা না। বরং বিপরীতটাই হচ্ছে। অনেক রকমের 'আনসলভড থিংকিং' আমাকে স্তব্ধ করে রেখেছে!

৩ নভে, ২০১০

পথ চলা, ফিরে দেখা, আর কিছু দীর্ঘশ্বাস

সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আশায় দাঁড়িয়ে ছিলাম ধানমন্ডির এক বাস কাউন্টারের সামনে। পূর্ববর্তী বাস স্টপেজ থেকে বাসগুলো পুরাই ভর্তি হয়ে আসছিলো। অফিসফেরত, কলেজ ফেরত, মার্কেটফেরত লোকজনের ভীড়ে কোন একটা দরজাতে যে জায়গা করে নিবো-- সেই সুযোগও হচ্ছিলো না।

তবু ভাবলাম, তারুণ্যের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কোনরকম একটা চিপাচাপায় জায়গা করে নিতেই হবে। ফাঁকা রাস্তায় যেই দুরত্বে লাগে মাত্র ১৫ মিনিট, যখন ব্যস্ত দিনে বাসে চড়ি তখন সেটুকুতেই লেগে যায় দেড় থেকে দু'ঘন্টা (ব্যস্ত ঢাকাবাসীর ভীড়ের মর্জিমতন)। আর সেই বাসটাতে উঠবার সৌভাগ্য অর্জন করতে আবার প্রায় আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নিত্য। কিন্তু সেদিন যেন আর তর সইছিলো না...

পরের বাসে সুযোগ করে কোনমতে দরজার সামনেই জায়গা করে নিলাম, অন্ততঃ পথের ধোঁয়া মিশ্রিত বাতাসটা হলেও যেন গ্রহণ করা যায়। নতুবা বাসের ভিতরের দমবন্ধ হয়ে আসা বাতাসে ঘর্মক্লান্ত বাংলার মানুষদের আধা ইঞ্চি দুরত্বে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাটা খুব বিরক্তিকর, অসহায়ত্ব... অসহায়ত্ব বললাম এই জন্য যে, যখন হঠাৎ বাসটা ব্রেক কষে, তখনই আরেকজনের গায়ের উপরে বেঁকে যেতে হয়, আর তখন সেই মানুষটা কিঞ্চিৎ বোধস্বল্প হলেই ঝাড়ি অবধারিত... তখন এরকম একটা অনাকাংখিত ঘটনা নিয়ে ক্লান্ত দেহ আর তিক্ত মনে কী করবো ভেবে খুবই মন খারাপ হয়। তাই, একটু বেশিই সাবধান থাকি...

তবু একটুও স্বস্তি হয়না, নতুন স্টপেজে আরো কিছু মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি... আমি যেমন যেভাবেই হোক ওঠার জন্য ত্রস্তব্যস্ত ছিলাম-- এই মানুষগুলোর চোখেও একই দৃশ্য দেখে বড্ড মায়া হয়। কোনরকমে এক পা ঝুলে যেতে চাওয়া ছেলেটাকে জায়গা করে দিলাম সেদিন। আমারই বয়েসি ছেলে। কিন্তু নিজের জায়গাটা হয়ে যাবার পর সে কিছুতেই আর মানুষকে উঠতে দেবে না!! অথচ পরের স্টপেজে দু'জন মানুষ নেমে যাওয়ায় খালি হওয়া জায়গাতে অন্তত একজন গায়ে গা লাগিয়ে হলেও যেতে পারে... অফিসফেরত ক্লান্ত মানুষগুলো কতনা অসহায় হয়ে বাড়ি ফিরতে চায়!! একটু তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিলেই আমাদের ঢাকাবাসীদের প্রতি করুণা জেগে উঠবে অন্য যে কোন মানবমনের...

সেই তরুণ ওই দরজার সামনে ঝুলে থেকেই দেশের মানুষকে, রাজনীতিবিদদেরকে গালাগালি শুরু করলো। তার কথার তুবড়িতে সারাদিনের ক্লান্তিকে আরো বেশি নির্মম লাগতে থাকে। পারতপক্ষে অযথা স্থানে এলোমেলো কথা না বলার চেষ্টা করি আমি। তবু তখন ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে তাকে প্রশ্ন করে বসলাম-- "ভাই, আপনার পক্ষ থেকে সলিউশান বলেন দেখি এই অবস্থার!" সে কিছুই বলতে পারলো না-- যুক্তিহীন কিছু অপলাপ করলো মিনিটখানেক।

এরপর সুন্দরভাবে তাকে যা বললাম গরম মেজাজে তা আমার কাছে ভালোই লেগেছিলো। কথাগুলো এমন ছিলোঃ
-- আমাদের দেশের সরকার মানে আমাদেরই প্রতিচ্ছবি। আমরা যেমন তেমনটাই হচ্ছে, স্রেফ পরিষ্কার ব্যাপার!!
-- একটা ফ্লাইওভার যদি প্রতিদিনের এই যানযটে কোন সুরাহার একটা পদক্ষেপ হয়-- সেইটা বানাতে আপনি রাস্তা খুঁড়বেন-- তখন রাস্তা আরো চিপা হবে-- আরো বেশি জ্যাম হবে...
-- প্রতিদিন অন্তত হাজার মানুষ এই তিলোত্তমা নগরীতে ঢুকে। কেউ বের হয় কিনা জানিনা।
-- রাস্তায় বাসগুলোতে যারা উঠেন, সেই মহিলাদের কোলে-কাঁখে পিচ্চি-পুসকা থাকে, হাত ধরে থাকে আরেকটা...


প্রতিদিন যেই মানুষগুলো ঢাকায় ঢুকছেন-- তারা বাইরে কেন জীবিকার সন্ধান পাচ্ছেন না? সরকার যিনিই আসছেন ক্ষমতার গদিতে-- অদ্ভূত কিছু ইস্যু নিয়ে, আবেগময় কথন দিয়ে আমাদের "ভ্যাকুয়াম হেড" কে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন বছরের পর বছর... নৈতিক আর ব্যক্তিগত চরিত্রে অতিশয় দীন, হীন রিক্ত নেতা আর রাজনীতিবিদ, সুবিধাভোগী মানুষগুলোর ব্যঙ্ক একাউন্টগুলো অর্থে সিক্ত...

আর আমরা সেই আমজনতা... প্রতিদিন রোদে পুড়ি... ঘামে ভিজি... বৃষ্টিতে সিক্ত হই... প্রায় সমস্ত জাতীয় সুযোগকে করুণার মতন করে পেয়ে চলি... তারপর, পরিষ্কারভাবে দ্বি-বিভক্ত দেশের রাজনীতির কোন এক অংশের অন্ধ আনুগত্যকে আপন করে বিলিয়ে দেই নিজেকে...

হায়! জাতীয় জীবনের অর্থই তো বোধ করি আমরা জানবো না কোনদিন... পৃথিবীটা অনেক সুন্দর আর সহজ হতে পারতো! মাঝে মাঝে নিজের প্রতি, নিজেদের প্রতি বড্ড করুণা হয় আমার!

* * *
১৮ অক্টোবর ২০১০, রাত ০৮:১৫

বদলে যাওয়া নিয়ে কিছু কথা


আমরা উত্তরোত্তর আধুনিক হচ্ছি। উন্নত থেকে উন্নততর।

আগে আব্বা আম্মারা তাদের মধ্যে কথাবার্তা 'মেলামেশা' ছাড়াই বিয়া-শাদী করেছিলেন। সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। আমাদের দেখলে গলার কণ্ঠ নামায়া ঝগড়া করতেন। কথায় কথায় তারা বাপের বাড়ি 'যাও', 'যাবো' বলতে পারতেন না, বলতেন না... একাট্টা হয়ে দু'জনে মিলে যুদ্ধ করে সংসার নামের নৌকাটার হাল ধরতেন চরম দুর্দিনেও...

আমরা 'দেখাদেখি' 'মিলামিলি' আর 'মিশামিশি' ছাড়া কল্পনাই করতে পারিনা বিয়েশাদী। আধুনিকা মেয়েরা অচেনা ছেলেদের সাথে বিয়ে করাকে "শুয়ে পড়া" বলে 'ডিনোট' করতে পছন্দ করেন। আধুনিক আমাদের পুলাপাইনরা ফেসবুকে দিনে রাতে স্ট্যাটাস বদলায়া "সিঙ্গেল" থেকে "ইন আ রিলেশনশিপ" আর "ইটস কম্পলিকেটেড" বানায়......ভাইস ভার্সা।

লোকে আমায় কাব্য লিখতে নিষেধ করে

লোকে আমায় কাব্য লিখতে নিষেধ করে
কাব্যে তারা খুঁজে পান স্থবিরতা
কাব্য নাকি কঠিন লাগে!!

অথচ আমি জানি আমি 'কাব্য' লিখতে পারিনা!
আমি চাই শুধু শব্দগুলো দিয়ে অনুভূতির মালা গেঁথে যেতে
অবিশ্রান্ত; অপার ভালোবাসায় আর অনুপ্রেরণায়,
কখনবা হতাশা আর তীব্র কষ্টের অনুভূতিতে।

কাব্য ছাড়া ভালোবাসা কী করে প্রকাশ হবে?
আমার অনুভূতিগুলোর আঁচড়ে কীভাবে
রূপ পাবে শত সহস্র শব্দমালা
আর ভালোবাসার রাতগুলো, স্বপ্নগুলো!


আজ তোমাদের মাঝে এসেছি,
এই জনারণ্যে-- লোকায়তনে
আমাকে ছড়িয়ে দেয়ার অভিপ্রায়ে।
আমার শব্দ আর ঐকতান নিয়ে,
তোমাদের মাঝে মিশে যেতে
আমি এসেছি তোমাদের মাঝে
নিঃসঙ্গ এই সাঁঝে।

ভালো থেকো বন্ধুরা,
আবারো কাব্য! -- তাই করিয়ো ক্ষমা...


২৫ সেপ্টেম্বর ২০১০, সন্ধ্যা ০৬:৪৩

অনুভূতিমালার বিচ্ছিন্ন বচন

রাত কেটে সকাল হলো 
আর দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা 
জাগতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি একটুও 
ঘটেনি নিয়মের জালে নিজেকে আটকানোর 
অন্তহীন প্রচেষ্টা। তাই স্তব্ধ আমি। 

নিরুপায় হয়ে আটকে আছি আজ ভদ্রদের মাঝে 
বুকের মাঝে চেপে থাকা কান্নাগুলোকে সাথে করে 
হাসিমুখে কথা বলি বসের সাথে, কলিগের সাথে। 
 
 অথচ আমার ইচ্ছে করে আংরাভাসা নদীর তীর দেখতে 
ইচ্ছে করে অপুর সাথে চৈতালি হাটে বেড়াতে যেতে। 
আমার বড্ড কাঁদতে ইচ্ছে করে। 
ইচ্ছে করে উন্মাতাল ঢেউতে ভেসে যাই... 
তবু তো অভিমানে হারিয়ে যাওয়া যাবে! 

১৫ সেপ, ২০১০

ক্ষমা করো হে বৃদ্ধাশ্রমের বাবা-মা

আমার বাসায় 'ডিশের লাইন' নাই। বিটিভি দেখাও হয় না। ঈদ উপলক্ষ্যে 'ইত্যাদি' দেখতে বসেছিলাম ঈদের আনন্দ নেবার অংশ হিসেবে। একদম শেষ এসে 'সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গানটা হচ্ছিলো -- বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে। লিরিক অসামান্য, আর সেই ভিডিওতে অংশ নিয়েছেন ওল্ড হোমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা...

গানের একটা অংশে দেখাচ্ছিলো এক বাবা তার জমানো সমস্ত টাকা দিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠালেন-- সেই ছেলেও আর খোঁজ নিলো না তার। শেষ বয়েসে তার ঠিকানা হলো বৃদ্ধাশ্রম। এই জায়গাটায় এসে চোখের অশ্রু আর রুধতে পারলাম না।

অদ্ভূত মনুষ্যত্ববোধ আমাদের! দিন দিন এই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বেড়ে চলেছে এই দেশে। দুঃখজনক আর কষ্টকর। নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম গানটি মনে হয় সবাইকেই স্পর্শ করে যায়।

যেই মা প্রতিদিন অনেক অনেকবার করে গায়ে পেশাব-পায়খানা করা সন্তানকে পরিষ্কার করেছেন, পরিপূর্ণ অসহায় অবস্থায় থাকা সন্তানকে শত সমস্যাতেও ছাদ হয়ে বড় করেছেন-- কীভাবে বড় হয়ে তাকে 'বুড়া আঙ্গুল' দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব!!

ক্রমাগত স্বার্থপরতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছি আমরা। তাই যখন বড় হয়ে যায় সন্তান-- তখন বৃদ্ধ বয়েসে আবারো শিশুসুলভ অসহায়ত্ব চলে আসা বাবা-মা কে ওল্ডহোমে পাঠিয়ে দিচ্ছি... পশ্চিমাদের ভালো গুণ না-- তাদের এই নোংরা গুণকে আয়ত্ব করছে নতুন প্রজন্ম...

জানিনা এই 'ইভোলিউশনের' শেষ কোথায়...

কখনো কখনো ভাবনারা ঠিক প্রকাশ হয় না। অনুভূতির তীব্রতায়। আমার বুক জুড়ে এখন তিতকুটে অনুভূতি... অথচ লেখায় আসছে না কোন প্রকাশ...

ঘৃণা করি আমাদের এই "পরিবর্তন", এই "প্রোগ্রেসিভ" সমাজকে।

২ সেপ, ২০১০

সুগন্ধে মৌ মৌ চারিধার

লেখার আগেই শিরোনাম দিয়ে বসলাম। সচরাচর এই কাজটা আমি করিনা, তবু আজকে করলাম। হয়ে গেলো। আসলে আমি আপাতত কোন ফুল বাগিচায় বসে নেই। আহারে, ফুল বাগিচা শব্দটা লিখতেই একটা গানের কথা মনে পড়ে গেলো-- "যত ফুল ফুটে, ফুল বাগিচায়... তারা সবাই তো নয় গোলাপ ফুল"...

যাক গে, সুগন্ধে মৌ মৌ চারিধার--- এই কথাগুলো মনে হয় কোন একটা বিজ্ঞাপনে শুনেছিলাম। আমি আসলে কোন পারফিউমের দোকানেও নাই। তাহলে সুগন্ধ কীসের?? এই প্রশ্ন আসাটাই অতীব স্বাভাবিক। একটু পরে বলি?

আমিও রোদ্দুর কী হতে চেয়েছিলাম অমলকান্তির মতন !

আমার অনেক কিছু ইচ্ছে করে। লিখতে বড্ড ইচ্ছে করে... ইচ্ছে করে লিখে লিখে পাতা ভরিয়ে দিবো। ইচ্ছে করে কখনো কল্পনাগুলোকে সত্য করে ডানা ছড়িয়ে দিতে দিবো।

ইচ্ছে করে অমলকান্তির মতন রোদ্দুর হতে... অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। অথচ ওর বন্ধুরা সবাই পেরেছিল, কেউ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা শিক্ষক।

সবাই পারলো। শুধু অমলকান্তিই পারেনি। সে তো রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো। সবকিছু ছেড়ে রোদ্দুর কেন? আমার বড্ড তারা হতে ইচ্ছে করে যেমনি করে, ওভাবেই? জানিনা। হয়ত অমনটাই কিছু হবে। আমিও চেয়েছিলাম তারা হয়ে রাতের আকাশটায় জেগে থাকতে, মানুষ হয়ে এই ভারসদৃশ জীবনটা বয়ে বেড়াতে চাইনি।

বন্ধুরা সবাই অনেক কিছু হয়ে গেলো। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যরিস্টার... আর আমি আগের স্বপ্নচারীই থেকে গেলাম... শুধু স্বপ্ন দেখে বেলা কেটে যায়... অপসৃয়মান সূর্যালোকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে বুঝি দু'একটা নিঃশ্বাস ফেলি বৈকি! দিন শেষে সন্ধ্যা নামে... আমি দিগন্তে চেয়ে থাকি...

রোদ্দুরও হতে পারলাম না। পারলাম না রাতের আকাশের তারা হতে... একদম একজন মানুষই রয়ে গেলাম... হয়ত আমাকে নিয়ে আমার কোন বন্ধু একসময় কবিতা লিখবে, "স্বপ্নচারী রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো, চেয়েছিলো আকাশের তারা হতে"......

[২ সেপ্টেম্বর, ২০১০]