১১ জানু, ২০১৩

একটা জীবন আর অনন্তযাত্রার কথা

আমার কাছে মনে হয় প্রতিটা মানুষের জীবনই একেকটা মর্মস্পর্শী উপন্যাস হতে পারত। ঔপন্যাসিকরা তো তাদের দু'চোখ দিয়ে দেখা ঘটনা ও জীবনদর্শনগুলো থেকে লিখেন। অথচ কত কথাই তো লুকিয়ে থাকে প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের পরতে পরতে, প্রতিদিন। তারা হয়ত লিখতে পারেন না/লিখেন না বলে তা হারিয়ে যায় কালান্তরে...


জীবনপথে চলতে প্রায়ই চারপাশে দেখি কোমলপ্রাণ-স্বপ্নবাজ, পরিশ্রমী-বুদ্ধিদীপ্ত, উন্মাদ-স্বেচ্ছাচারী-স্বার্থপর, পরোপকারী-হৃদয়বান থেকে শুরু করে আরো হাজার রকম মানুষ। সুন্দর পরিবেশে বসে বিশ্বের সেরা ভার্সিটিগুলোর একটাতে গবেষণারত বন্ধুর পাশে বসেই দুপুরের খাওয়া আর চাটাই-ঢাকা বাঁশের মেঝের হোটেলে বসে রিকসাওয়ালা চাচার পাশে বসে খাওয়ার দু'টো অনুভূতি আমার কাছে একই রকম লেগেছিল। পাশে বসা দু'জনই মানুষ ছিল, তারা দু'জনের তাদের সাধ্যমতন চেষ্টা করে যায় জীবনযুদ্ধে... একজনের গায়ে ছিলো পারফিউমের সুঘ্রাণ, অন্যজনের ঘাম। পার্থক্য কতটা গভীর এক দেখায়?

প্রায় প্রতিদিনই দেখি, অফিসে-পথেঘাটে প্রতিটি মানুষই তাদেরকে *এক্সেপশনাল* হিসেবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করে, হয়ত তেমনটা বিশ্বাসও করে। নিজেকে আলাদা-ভিন্ন, স্পেশাল হিসেবে তৈরি করতেই জীবন পেরিয়ে যায়। আমিও কখনো ভাবতে থাকি এমন করেই। ঘোর কাটে মৃত্যুর সংবাদ শুনলে। আজ জুমু'আ শেষ করে মসজিদ থেকে নামার সময় খাটিয়াটা চোখে পড়লো, খাটিয়ার নিচের মেঝেতেও ধূলোর আস্তরণ -- খাটিয়া চকচকে। নিয়মিত এলাকার মানুষদেরকে এটাতে শুইয়ে কবর জানাজা পড়ানো হয়। চলে যাওয়া মানুষটার রেমন্ডের স্যুট, রোলেক্সের ঘড়ি, বিএমডাব্লু গাড়ির চাবি -- সবকিছু ছাড়াই তাকে মাটির নিচে চেপে রেখে আসা হয়। আমার নিজেরও হয়ত জীবনের পার্থিব অর্জন খুব কম নয়, খুব বেশি তো নয়ই। কিন্তু, মাটিচাপা পড়ার পরে তো আমার আমি ছাড়া, আমার করে যাওয়া কিছু কাজ ছাড়া কিছুই যাবে না। তাই হয়ত খেজুর দিয়ে হলেও জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে জানিয়ে গেছেন আমাদের প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

আজকে যখন নামাজের পরে দু'আ করার সময় কোন একজন মরহুমের সন্তানের দানের বিনিময়ে উপহার তার বাবার কবরে পৌঁছে দিতে আল্লাহর কাছে চাওয়া হচ্ছিলো তখন মনে হলো -- ওই বাবা মানুষটা হয়ত আজকে হাসিমুখে এই হাদিয়া গ্রহণ করবেন। হয়ত সারা বছর ধরে মাত্র কয়েকটা উপহারই তিনি পান এমন করে, আর নয়ত পুরাটা সময়েই একা থাকা। কবরের সঙ্গী কেবলই ভালো কাজগুলো -- আমার রেখে যাওয়া হাসিমুখ কথা, আমার বিলিয়ে যাওয়া জ্ঞানের আলো, আমার করে যাওয়া ভালো কাজ, কল্যাণকর কাজের ন্যূনতম চেষ্টাগুলো; যা রয়ে যাবে এই পৃথিবীতে। আমার পুঁতে যাওয়া গাছের চারা বড় হয়ে পথিককে ছায়া দিলেও হয়ত আমার অন্ধকার কবর আলোকিত হবে। খারাপ কাজগুলোও একইভাবে ভোগান্তি বাড়াতে থাকবে সেখানে, পুনর্জাগরণের পূর্ব পর্যন্ত...

এই চিন্তাগুলো আমার না পাওয়ার, হারানোর, শারীরিক-মানসিক কষ্টে ভুগতে থাকা সময়ে তীব্র চপেটাঘাতের মতন হয়। সম্বিত ফিরে পেয়ে লজ্জায় অধোবদন হই। আরো বেশি লজ্জা হয় যখন কেউ আমাকে, উনাকে, তাদেরকে বিচার করতে বসে যায়-- "অমুক খারাপ, অমুক ভালো, তার এটা এমন, তার ওটা অমুন না। তাকে আমার অতিরিক্ত টাইপের লাগে... "।

অন্তরের খবর কে জানি আমরা? কে জানি কে আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দের? কার হৃদয়ের চাওয়া বেশি গভীর তা কে পারবে মাপতে? নিজেদের অন্তরের গভীরে কয়বার তাকাই? সেখানে শরীরের খায়েশ, মনের খায়েশ, দম্ভ-অহংকার, প্রদর্শনেচ্ছা, স্বার্থপরতা পেরিয়ে কতটুকু কাজ অবশিষ্ট থাকে -- ভেবে কি দেখি কখনো? অন্তরের শূণ্যতা তো মহান আল্লাহর সান্নিধ্য পাবার আগে কখনই পূর্ণ হবেনা। সবকিছু ফেলে তাই প্রার্থনা হয় -- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা যেন আমাদের জীবনগুলো কবুল করেন। কবরের অন্ধকার ভীতিকর সময়ে যেন তিনি আমাদের আলোকিত করে দেন। আমাদেরকে যেন সেই সময়ের জন্য কিছু নিয়ে যাওয়ার তাওফিক দান করেন এই পৃথিবীতেই। রব্বুল আলামীনের সাথে আমাদের সাক্ষাতটা যেন হয় প্রশান্তিময়, অনন্ত আনন্দের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে