৫ ডিসে, ২০১২

একটি বন্ধু এবং একটি বইয়ের কথা

আমাদের একটা বন্ধুসার্কেল ছিলো, বহুমাত্রিক। আমাদেরই ফ্রেন্ড সার্কেলে এক বন্ধুর আন্তর্জাতিকভাবে পেটেন্ট পাওয়া রিসার্চ আছে, পিএইচডি প্রায় শেষ করে ফেললো। দুই হাতের আঙ্গুল দিয়ে গুণে বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেদের হিসেব করতে হবে। কিন্তু অসাধারণ প্রতিভার এতজনের কাউকেই আমার তেমন একটা হিংসে হত না সেই স্কুলজীবন থেকেই। আজকেও হয়না। অবশ্য এখন জানি, কেবলমাত্র দ্বীনের জ্ঞানে এগিয়ে থাকা এবং দানশীলতায় এগিয়ে থাকা মানুষদের ছাড়া কাউকে হিংসা করার নিষেধ। তাই এখন দুনিয়ার বিভিন্ন কাজে এগিয়ে থাকা মানুষদের প্রতি এমন হিংসাকে প্রশ্রয় দেবার প্রশ্নই উঠেনা।


এদের মধ্যে একটা বন্ধু ছিল, যে সবসময়েই এগিয়ে থাকত। একবার কলেজের লাইব্রেরিতে গেলাম, অন্য অনেক বন্ধু বসে হুমায়ূন পড়তে গেলো, ওই বন্ধু এক কোণায় বসে আবু ইসহাকে সূর্যদীঘল বাড়ি পড়লো। কখনো সে রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' হাতে নিয়ে আমার সাথে মূলচরিত্রটার উপরে একটা আলাপ সেরে নিত, আমি হু-হা করে মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। ওর কারণে বাংলা সাহিত্যে অনেক ডুব দিয়েছিলাম, সাহিত্য নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে খুব আগ্রহ ছিলো আমার। ওর সাথেই স্কুল জীবনে লেখা কবিতাগুলো শেয়ার করতাম। শব্দ নিয়ে খুঁতখুঁতানি এই বন্ধুটার কাছেই শিখেছি। একবার কবিতার ডায়েরি টেবিলের উপরে সশব্দে রেখে দিয়েছিলো কবিতা অপছন্দ হওয়ায়, খুলে দেখি অনেকগুলো লাল কালির দাগ।


তখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কলেজের একটা অনুষ্ঠানে সবার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিলো। তখনো আমাদের ক্লাসমেটদের বেশিরভাগের আলাপ হতো খুব তুচ্ছ সব ফান-জোকস, নতুন প্রেম করতে শুরু করা কারো গার্লফ্রেন্ড ও তাদের তুচ্ছ অর্থহীন আলাপ-প্রলাপ -- তাই খুঁজে পেতে বন্ধুর পাশে গিয়ে বসলাম। দেখি সে একটা বই পড়ছে -- "মক্কার পথ : দি রোড টু মক্কা", বইটা লিখেছিলেন মুহাম্মদ আসাদ। বইয়ের সাইজ দেখে আশা ছাড়লাম, তখন পড়াশোনা নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলাম। উচ্চমাধ্যমিক রসায়নের টাইট্রেশন ও জারণ-বিজারণ সংক্রান্ত অংকের চিন্তায় আমি অস্থির। কিন্তু এরপরেও ও আমাকে হাসিঠাট্টা করলো বইটার প্রতি আকর্ষণ অনুভব না করায়। সেই বইগুলো আমার আর পড়া হয়নি।


কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে যেই দু'একজনের কাছে আলাপ করতে যেতাম, তার মধ্যে এই বন্ধুটি একজন। একসাথে কোন মসজিদে নামাজে ঢুকলে নামাজ শেষে বের হয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতে হত, নফল নামাজের প্রতি ওর টান আমাকে আরো আরো নফল পড়তে উৎসাহিত করত। শান্তমুখে কোন কাজ করব কি করব না -- এমন ফিল্টারিং করার অ্যাপ্রোচ আমি দু'জন বন্ধুর কাছে শিখেছিলাম। মাঝে কিছুকাল কমিউনিকেশন গ্যাপ ছিল। অনেকদিন পরে যখন আবার যোগাযোগ হলো নিয়মিত আকারে -- বন্ধুটি তার অনতিকাল পরেই দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করে ফেললো। ওর দ্বীনের জ্ঞানের গভীরতা আর শান্ত বিবেচনাবোধগুলোর কারণে আজো আমি খুবই ঈর্ষা করি।

আজকে হঠাৎ মনে পড়লো ওর কথা, 'Road To Mecca : মক্কার পথ' বইটার লেখক মুহাম্মদ আসাদের একটা অসাধারণ উদ্ধৃতি পড়ার পরে। কখনো জানতাম না, জীবনে বদলে এমন জায়গাতে আসবে, ঐ বইটা পড়তে এরকম তীব্র আগ্রহবোধ করব। হয়ত আগের মতন সবুজ মাঠের সামনে দুই বন্ধু বসে চিন্তাহীন আলাপ আর হবেনা। তবে সেই দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে দু'ছত্র জ্ঞানের আলাপ হতেই পারে... সবই আমাদের আল্লাহর মহাপরিকল্পনার অংশ, আমরা তার রাহমাতপুষ্ট ক্ষুদ্র বান্দা।

 প্রয়োজনীয় লিঙ্ক 

  [পিডিএফ] রোড টু মক্কা 'Road To Mecca' -- মুহাম্মাদ আসাদ [মক্কার পথ]
  [লিঙ্ক] ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ইসলামে ফিরে আসা মুহাম্মাদ আসাদের আরো কিছু বই



স্বপ্নকারখানা, তিলোত্তমা নগরী
০৫ ডিসেম্বর, ২০১২ ঈসায়ী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে