অনন্যা হঠাৎ এতটা বদলে যাবে আশা করিনি। ও সবসময়েই আমাকে পছন্দ করত, আর সেইটা বাড়াবাড়ি টাইপের পছন্দ ছিল। সেই পছন্দের সাথে মুগ্ধতা ছিল বলে মনে হত আমার। অনন্যাকে নিয়ে আমার অধিকার অনুভব করার ব্যাপার ছিল সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। আমার স্কুল ছুটি হত আগে, সে বাসায় ফেরার সময় আমি মাঝে মাঝে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে যেতাম। সিঁড়িতে দিয়ে উঠার সময় আমার দিকে হাসি দিতো অনন্যা। ও হাসলে গালে টোল পড়ত, আমার সেইটা খুব পছন্দের ছিল।
ক্লাস ফোরে উঠতেই আমাদের বাসা বদলে গেল। ওরা তখনো আগের বাসায় থাকে। অনেকদূর হেঁটে ওদের বাসায় যেতে হত। আমি যেতাম মাঝে মাঝেই। খালাম্মা আগের মতন আদর করত না টের পেতাম। আগে বাসায় গেলেই খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে স্কুলের প্রশ্ন করতেন, আম্মা আর ভাইয়া আপুদের কথা জিজ্ঞেস করতেন, পরে কেমন না দেখার ভান করতেন যেন। বুঝতে পারতাম তাল কেটে গেছে।
বড় হতে হতে সব কিছু বুঝে যাতায়াতও কমিয়ে দিয়েছিলাম। কথাবার্তা কম হতে হতে একদিন ভুলেও গিয়েছিলাম ওর কথা। মাঝে মাঝে মনে হত, যখন কবিতা পড়তাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েছিলাম ক্ষণমিলন -- "মূহুর্ত আলোকে কেন হে অন্তরতম, তোমারে হেরিনু চির পরিচিত মম।" এই কবিতা পড়ার পর আমার অনন্যার কথা মনে হত।
বেশ অনেক বছর পর, এসএসসিতে আমি অনেক ভালো করলাম। অনন্যার কথা মনে হতে খোঁজ নিয়ে শুনি ও সাইন্স নিতে পারেনি নাম্বার ভালো ছিলনা। হিউম্যানিটিজে ভর্তি হয়েছিল। রেজাল্টও খুব একটা ভালো হয়নি।
এরপর আরো সময় পর... একদিন অনাকাংখিতভাবে ফেসবুকে ওকে পেলাম খুঁজে হঠাৎ করেই, জানতে পারলাম শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। মেসেজ করে জিজ্ঞাসা করলাম, "অনন্যা চিনতে পারছ? মনে আছে আমাকে"?
রিপ্লাই দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম, খুব আবেগ দিয়ে উত্তর ছিলো,
"সাদ তুমিইই!! তোমাকে অনেক খুঁজেছিলাম আমি, এইচএসসির রেজাল্টে পত্রিকায় তোমার ছবি পেয়ে আম্মুকে দেখিয়েছিলাম আমি। ভালো আছ তো?"
আমি আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম খানিকটা, উত্তর দিলাম "আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন? ভালো আছ?"
-- অনেক ভালো আছি। কিন্তু ভার্সিটি ভালো লাগেনা। ঢাকায় তো থাকতে পারলাম না...
আরো কিছু কথার পর ইনফো ঘেঁটে দেখতে পাওয়া তথ্য থেকে বুঝেই জিজ্ঞাসা করলাম, "অরণ্য কি তোমার ক্লাসমেট?"
ওর উত্তর ছিল, "হ্যাঁ। এইতো অল্প ক'দিন হলো আমাদের অ্যাফেয়ার। ও দারুণ আকর্ষণীয় ছেলে। আর অরণ্য নামটা অনেক সুন্দর না বলো?"
আমি উত্তর দিলাম, হ্যা। অনেক কাব্যিক নাম।
-- ও আসলেই কাব্যিক। আমাদের ভার্সিটির আবৃত্তি সংসদে খুব অ্যাকটিভ ও। তুমি একদিন এসো আমাদের ক্যাম্পাসে। আমরা একসাথে ফুচকা খাবো নাহয়। তুমিও অরণ্যের সাথে পরিচিত হতে পারবে।
সেদিনের আগে আমি ঠিক জানতাম না যা কখনই ছিলনা, তাকেও হারানো যায়। আর এই হারানোর যন্ত্রণাটা সামলে ওঠাও কঠিন। । আজকে অনন্যা আমাকে অরণ্যের সাথে পরিচিত হওয়াকেই বেশি বড় করে দেখালো। এত বছর পর আমি যে সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়ছি, সেটাকে সে ভ্রূক্ষেপই করল না।
অনন্যাকে সেদিন আর বলিনি আমার কোন অনুভূতি। আমি আর ওকে ফ্রেন্ড বানাইনি ফেসবুকে। কিছুদিন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ঝুলিয়ে রেখেছিল তাই নিজ থেকে রিকোয়েস্ট রিমুভ করে ফেলেছিলাম। মাঝে মাঝে খেয়াল হতেই দেখতাম, কখনো শাড়ি পরা অনন্যার হাসিমুখ টোলপড়া গাল, কখনো হাতের সোনালী অলংকার, কখনো মেহেদি মাখা আংটিপরা হাতের ছবি বদলে যেত প্রোফাইল পিকচারে। আমিও বুঝতাম, অনন্যা কাব্যিক বয়ফ্রেন্ডের সান্নিধ্যে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। ছবিনেশায় আক্রান্ত অনেক মেয়েদের মতন অনন্যাও হয়ত এখন অরণ্যের ডিএসএলআর ক্যামেরার সামনে অনেক সময় কাটায়, ফেসবুকে আপলোড করে বন্ধুদের কমেন্ট পেয়ে আত্মতৃপ্তি নেয় দু'জনেই। জানিনা আমি...
বছরখানেক পর একদিন ওদের বাসার সামনে দিয়ে আসার সময় চলে গেলাম। ওদের বাসায়। ভাইয়াদের একজনকে পেলাম, খালাম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, অনন্যা কোথায়?
-"ওর বন্ধু এসেছিল বাবা, তার সাথে টিএসসিতে গেলো, আজকে নাকি ওদের গেটটুগেদার আছে" -- খালাম্মার উত্তর শুনে অনন্যাকে ফোন দিলাম, পুরুষালী গলা শুনলাম ব্যাকগ্রাউন্ডে, অনন্যার উত্তর ছিলো, "শুনতে পাচ্ছিনা সাদ, পরে ফোন করিও।"
সেদিনের পর আর কখনো ফোন করিনি। কারো সাথে অযাচিত হয়ে আলাপ করার আমার ইচ্ছে ছিলনা। অনেকদিন পর এলাকায় অনন্যার এক ঘনিষ্ট বান্ধবীর সীমার সাথে দেখা। আমারো ছেলেবেলার ক্লাসমেট ছিল। সেদিন ওকে ১০ বছর পর দেখলাম। কথার প্রসঙ্গে ওর কাছে অনন্যার আপডেট জানতে পারলাম। ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পর নাকি অরণ্য বদলে যায়। নৃতত্ববিদ্যা পাশ করে ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে আগ্রহী স্পাইকি চুল, হাতে ব্রেসলেটের প্রোফাইল পিকচারের অরণ্য আর সেই সাদামাটা হাসিমুখ অনন্যার রিলেশন ৩ বছর পর ভেঙ্গে যায়। অনন্যার আরেকটা ছেলের সাথে সম্পর্ক হয়েছে, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে একসাথে চাকুরি করে ওরা। সীমা বললো, অনন্যা বলেছে, অরণ্য একটা স্বার্থপর লম্পট।
সেদিন বিকেলে সীমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরছিলাম আমার চাকুরিস্থলে। সিলেটের পথে বাস ছুটে চলেছিলো দু'পাশের গাছগাছালির মাঝ দিয়ে। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিলো বলে জানালা বন্ধ করিনি। মুখে বৃষ্টির ছাঁট আর বাইরের সবুজ অরণ্য দেখে অনন্যা আর অরণ্যের কথা মনে হলো। অনন্যারা অরণ্যদের কাব্যিক নাম দেখে, ওদের হ্যান্ডসাম লুক দেখে, কবিতা আবৃত্তি শুনে, গিটার হাতে নিয়ে গাওয়া গান শুনে প্রেমে মজে যায়। তারপর একটা সময় অরণ্যরা স্বার্থপর লম্পট নাম পায়, অবধারিত সত্য।
তবু অনন্যারা ভুল করে। সাদামাটা চেহারার এমন কারো দিকে ফিরে চায় না, যারা হয়ত অরণ্যের মতন গহীন ভালোবাসা ধারণ করে বুকে। সেই ভালোবাসার হয়ত জৌলুস দেখা যায়না। অনেক সময় বুক ভরা স্নিগ্ধ ভালোবাসা থাকে, তার হয়ত অরণ্যময় ভালোবাসার প্রকাশ থাকেনা, কিন্তু বুকের ভিতরে তারা তরঙ্গায়িত করে অনুভূতিদের। তারা জীবনসঙ্গী করেই ভালোবাসতে চায়, রঙ্গিন করতে চায়না নিষিদ্ধ জীবনকে, সঙ্গিনীর জীবনকে রাঙ্গাতে চায় সমস্ত অধিকার হাতে নিয়ে তবেই। এদিকে অরণ্যরা প্রেমিকাদের জীবনকে তরঙ্গায়িত করে। এই বিপুল ব্যবধান কিশোরী তরুণী প্রেমিকারা বুঝেনা, তারা ভুল করে বারবার।
শেষ বিকেলে চিন্তাগুলোর সাথে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস, এক ঝাঁক অস্থিরতা জেগে উঠলো। সম্বিত ফিরে পেয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে প্লে লিস্ট থেকে মাহের জেইনকে বেছে নিলাম। গাইড মি অল দি ওয়ে প্লে করতেই স্নিগ্ধ আবেগে কানে বেজে উঠলো --
I know that You could easily
Take away every thing You’ve given me
And I try to remember
Not to take anything for granted
Cause I know that one day
Suddenly this will all come to an end
So my last wish is for you to be pleased with Me
Allah, Ya Allah
Guide me all the way to your Jannah.
.....
Forgive me, cause I cant thank you enough.
Forgive me when I doubt your love.
গানের কথাগুলো শুনে আর অনুভব করে প্রশান্ত হয়ে গেলো মন। যার ভালোবাসায় আমি পূর্ণ হব, তিনি হারিয়ে যাননি এখনো এই সাদামাটা মানুষটার জীবন থেকে -- এর চাইতে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে?
বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম তখন, অরণ্যের মাঝে সন্ধ্যা নেমে এলো প্রায়, গাড়ি ছুটে চলেছে সবকিছুকে পেছনে ফেলে। বুকের বামদিকে নিঃশব্দে হাত দিয়ে চেপে নিজেকে বললাম, ভালোবাসা চিনতে ভুল করো না সাদ। এই জীবন একটাই, এই যাত্রা অনন্তের.