২৪ অক্টো, ২০১২

আমরা পথে ঘাটে ভালোবাসা বিলি করে বেড়াই, ঘরে আমাদের দুর্ভিক্ষ লেগে থাকে


আমরা কমিউনিকেশনের যুগে বসবাস করছি, যেখানে ভালোবাসা নামক পণ্যের প্রবল প্রচার আর প্রসারে ব্যতিব্যস্ত আমাদের জীবন। টেলিভিশন কমার্শিয়াল, সিরিয়াল, মুভি আর বিলবোর্ডের মাধ্যমে ডুবে থাকি ভালোবাসায়। আমাদের চারিদিকে ভালোবাসা -- ট্যালকম পাউডার বেচতেও ভালোবাসা, লোশন বেচতেও কোমলতার ভালোবাসা, ভালোবাসার টানে টেনে হিঁচড়ে পাশে মানুষ-অমানুষ সবাইকে নিয়ে চলে আসে মোবাইল অপারেটররা। আমাদের ভালোবাসারা বিক্রি হয় প্রতিটি পণ্যে।

এই ভালোবাসাবাসির দুনিয়ায় আমরা ঘরের বাইরে গেলে পরিচিত পরিমন্ডলে বেশ আমাদের অনেকেই বন্ধুদের সাথে, ক্লাসমেট ও কলিগদের সাথে, এমনকি হয়ত যেকোন অপরিচিত মানুষের সাথে বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলি, হয়ত প্রয়োজনেই। ইচ্ছে না হলেও অন্ততঃ চেষ্টা করি ভালোভাবে কথা বলতে যেন তাদের মনে খারাপ না লাগে। অথচ নিকটাত্মীয় ভাইবোন, বাবা-মায়ের সাথে কোন ধরণের সৌন্দর্য ছাড়া চাঁছাছোলা কুৎসিত শব্দ দিয়ে কথা বলি...


আমার বন্ধু এবং কলিগদের মাঝেই অনেকজনকে দেখেছি, যারা আমাদের সাথে হাসিমুখে খুব কৌতুক করে কথা বললেও বাসা থেকে ফোন আসা মাত্র নাক মুখ কুঁচকে কথা বলতে শুরু করে। মায়ের সাথে কথা বলে সবচাইতে কর্কশ আর নিরানন্দ ভাষায়, অথচ একই ছেলেটাকে দেখেছি একটা অনাত্মীয় মেয়ের সাথে কথা বলতে অনেক প্রস্তুতি নিতে... ব্যাপারটা দুঃখজনক। কেন এমন হীন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড?

আমাদের বাবা-মা তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা দিয়ে সমগ্র জীবন ধরেই আমাদের সাথে থেকে আমাদের গড়ে তোলেন, আগলে রেখে বড় করেন। ভাইবোনরা আমাদের শত-সহস্র দুঃখ সুখের সাথী, অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেই তারা আমাদের বড় হওয়ায় কনট্রিবিউট করেছেন -- আর তাই আমাদের প্রতি তাদের ভালোবাসা বর্ণনাতীত। আমাদের কাছে ভালো ব্যবহার, সুন্দর কথা পেলে তাদের অন্তরে প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়, যাওয়াই স্বাভাবিক। অথচ প্রায়সময়েই বন্ধুদের প্রতি আমাদের এতই বেশি খেয়াল থাকে অনেকের, আমরা ভাই-বোনকে যাচ্ছেতাই ভাষায় সম্বোধন করে কথা বলি। হয়ত দীর্ঘসময় পর হওয়া প্রথম কথপোকথনেই সরাসরি খুঁত ধরে আঘাত করে কথা বলতে শুরু করি ...

একদিন আমার অফিসের বস আমার একটা ভুলের কারণে বেশ আয়োজন করে ঝাড়ি দিতে চাচ্ছিলেন, আমার সাথে কথা বলার আগে তিনি আমার অপর একজন কলিগকে পুরা ঝাড়ি দিয়ে শুইয়ে দিলেন। আমি রীতিমতন টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। এমন সময় উনার মা ফোন করলেন। রাশভারি চল্লিশোর্ধ মানুষটা মূহুর্তেই ছোট বাচ্চার মতন হয়ে মায়ের সাথে কথা বলছিলেন কী গভীর ভালোবাসা দিয়ে তা আমার এখনো চোখে ভাসে! সামনে বসে মা-ছেলের কথোপকথন শুনে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল -- আমি আমার আম্মুর সাথে কখনো এত সুন্দর করে কথা বলিনি বিগত অনেক বছরের স্মৃতিতে। সেইদিন আমি অনেক বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। মায়ের সাথে মিনিটখানেক কথা বলার পর আমাকে কেবল কাজটা বুঝিয়ে উনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, মেজাজ একদম ঠান্ডা!

সুন্দর ব্যবহারগুলো, ভালোবাসাগুলোও সংক্রামক আসলে। প্রতিটা মানুষের ভিতরে সুপ্ত ভালোলাগা আর ভালোবাসারা জেগে ওঠে ভালোবাসার কথা, আর আচরণে। আমাদের উচিত জগতের সবার সাথেই সুন্দর শব্দ দিয়ে, উন্নত ভাষা দিয়ে কথা বলা। পরিবারের মানুষদেরকে ভালোবাসা উচিত সবচাইতে বেশি, তাদেরকে নিয়মিত বলা উচিত, "আম্মু, তোমাকে ভালোবাসি", "আব্বু আপনাকে আমি ভালোবাসি", "ভাইয়া, তোমাকে আমি ভালোবাসি," "আপু, তোমাকে ভালোবাসি"...

আমাদের পরিবারই আমাদের সবচাইতে বড় দায়িত্ব, আদর্শিকভাবেও এটাই আমাদের কাজের মূল জায়গা। আগে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করতে বলেছেন আল্লাহ। [১] তাদের প্রতি আমাদের অনেক মনোযোগ দেয়া উচিত, তাদের কাছেই আমাদের আলোকিত ভাবনাগুলোকে ধৈর্য্যধারণ করে শেয়ার করা উচিত । যদি আমরাই দ্বীনের আলোতে আলোকিত না হলাম, আমাদের চরিত্র আর ব্যবহারে উন্নত হয়ে তাদের কাছে জায়গা করে নিতে না পারলাম, তাহলে কি আদৌ কোন লাভ হলো? আমরা কি আদৌ উন্নত হলাম?

আমরা পথে ঘাটে ভালোবাসা বিলি করে বেড়াই, অথচ ঘরে আমাদের ভালোবাসার দুর্ভিক্ষ লেগে থাকে...


রেফারেন্স 

[১] আল কুরআন :: সূরা আত তাহরীম, আয়াত : ৬
[ভিডিও] নুমান আলী খান :: Today We Can, Tomorrow We Cannot
[প্রবন্ধ] অন ইসলাম ডট নেট :: Save Family, Save Society