২৬ ডিসে, ২০১৪

​বদলে যাওয়া সামাজিক সম্পর্ক ও আমাদের শিশুদের শৈশব হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কিছু কথা

সবারই শৈশব স্মৃতিময়, মধুময়। সম্ভবত শৈশবের ব্যাপারটাই আল্লাহ এমন করে আমাদের বুকে গড়ে দেন। যন্ত্রণায় অনেক সময়েই শৈশবের স্মৃতিগুলো আরাধ্য ভালোলাগা হয়ে ওঠে। ইদানিংকার শিশুদের শৈশব দেখে আমার নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে। আমরা তো আমাদের শিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়েছি।

আজ থেকে ২০ বছর আগেও আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি অনেকটাই স্থির ছিলো। গল্পের বইতে পড়ে থাকতাম, সেটাই ছিলো বিনোদন আমার। আমার মতন অনেকেই ছিলো। আসরের আজান হলেই কেবল কিছু ছেলেপিলে বাসার বাইরে বের হবার অনুমতি পেতো। ঢাকার অলিগলির রাস্তায় ক্রিকেট বল নিয়ে বা ফুটবল নিয়ে খেলা, রাতে আবার এশার পরে মাসজিদের সামনে থেকে গলির মাথা পর্যন্ত একটু গপশপ করা... শুক্রবারের সকালে ন'টা পর্যন্ত পড়ে তারপর খেলতে বের হওয়া টাইপের ব্যাপার ছিলো।


এখন আমাদের সন্তানগুলোকে বাবামায়েরা 'জ্বালা থেকে বাঁচতে' মোবাইল/টিভির সামনে বসিয়ে দেন। আমি অনেকগুলো পরিবারের সন্তানের কথা জানি যেখানে অনুর্ধ ৪ বছরের সন্তানরা সাবলীল হিন্দি পারে। সেসব কার্টুনে, মিউজিক ভিডিওতে স্বল্পপোশাকের নারীরা থাকে। এখনকার স্কুলগামী ছেলেদের খেলার মাঠের চাঞ্চল্য নয়, বরং 'গার্লফ্রেন্ড' বা মুভির নায়িকারা চাঞ্চল্যতার আলাপ। রাস্তার মোড়ে কিশোরদের পাশ দিয়ে আসার সময় আমি মোবাইল ফোন এবং মেয়ে ছাড়া কোন আলাপ কোনদিন শুনিনা। একই টিচারের কাছে ওরা পড়তে যায়, বের হয়ে খুঁনসুঁটি করে। এভাবেই গড়ে উঠছে আগামী দিনের ভবিষ্যত। এখন বাল্যবেলায় সন্তানরা আর বই পড়ে না। সাহিত্য হারিয়ে গেছে প্রায় সবার কাছ থেকেই। টেলিভিশন আর স্যাটেলাইটে বুঁদ হয়ে কাটায় বিনোদনের জন্য।

অনেকের জীবনে বিনোদনটাই জীবন হয়ে গেছে। বিনোদনের আয়োজনে সবকিছু। ফেসবুকে ছবি আপলোড, লাইক। নতুন ফ্রেন্ডের সাসপেন্স, অচেনা-অজানাদের সাথে ইনবক্সে কমেন্টিং। এই প্রজন্ম যখন বড় হবে তখন তাদের চারপাশটায় নৈরাজ্য থাকবে। জাতীয় পর্যায়ে এখন নির্লজ্জতা বেশ স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। বিবাহবহির্ভুত শারীরিক সম্পর্ককে স্বাভাবিক দেখিয়ে, "ভুল হতেই পারে" শিখিয়ে মেয়েদের 'কন্ট্রাসেপটিভ পিল' সংক্রান্ত কমার্শিয়াল এখন চ্যানেলে প্রচার হচ্ছে। কিশোরীরাও শিখছে, "এরকম হতেই পারে।" এই প্রজন্মকে কে শেখাবে দায়িত্ব, ভালোবাসা, সচেতনতা, সততা যে খুব দরকারী? এই পারিবারিক নৈরাজ্য ঠেকাতে কেউ আগ্রহী নয় কি?

প্রতিটি পরিবারে এখন অশান্তি। বিবাহিত দম্পতিরা এমনভাবে কাটাচ্ছে যেন তারা অবিবাহিত। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকা, বাসায় ফিরে দু'জনার আলাপ না হওয়া যেন পরিবারগুলোর নিত্য ঘটনা। অথচ কিশোর-তরুণরা অবিবাহিত হলেও এমনভাবে কাটাচ্ছে যেন তারা বিবাহিত। নির্লজ্জভাবে ফেসবুকে ছবি আপলোড করছে একেকজন, যদিও তারা কেউ স্বামী-স্ত্রী নয়, বরং Just Friends!!

স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পারস্পারিক বিশ্বাস। যারা এখন অনেকগুলো করে প্রেম করে বেড়ায়, অনেকজন বিপরীত লিঙ্গের সাথে যাদের ছবি তুলে আপলোড করে রাখে, তারা যখন পরস্পরকে বিয়ে করবে, কেমন করে তাকে আপন করে ভাববে? কেমন করে তখন তাদের বিয়ে আদৌ টিকবে? পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ তাদের কুরে কুরে খাবে।

এই সামাজিক নৈরাজ্য ঠেকাতে আমাদের সতর্ক হওয়া খুব দরকার। আগামী প্রজন্মের এই অনিয়ন্ত্রিত ধ্বংস হয়ত আমরা ১০-১৫ বছর পর থেকে পেতে শুরু করবো। ততদিনে আমাদের প্রায় প্রতিটি পরিবারের শান্তি হবে তিরোহিত। নিজেদের জীবনে শান্তি পেতে আমাদের খুব বেশি জোরেসোরে দাওয়াতের কাজ করা উচিত। আমাদের পরিবারগুলোতে ইসলামকে প্রতিষ্টিত করা আমাদের দায়িত্ব। যত কঠিনই হোক, এর গুরুত্ব বুঝে যেন আমরা আমাদের নিজেদেরকে ও নিজ পরিবারকে জাহান্নামের আগুণ থেকে মুক্তির চেষ্টা করি আজ থেকেই। আল্লাহ আমাদেরকে, আমাদের পরিবারগুলোকে, আমাদের সমাজকে হেফাজত করুন, আমাদের সবাইকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন।

[২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে