১৭ ফেব, ২০১৪

খেলাধূলা যখন ভয়ংকর এন্টারটেইনমেন্ট নেশা

এককালে আমি খুবই খেলাপাগলা ছিলাম। যেই বয়সে সবাই কার্টুন দেখতে আর কমিকস বই পড়তে দৌড়াইতো, সেই বয়সে আমি আমার বন্ধুর মামার বাসায় গিয়ে (ডিশের লাইন ছিলো) স্টার স্পোর্টসে মামার পাশে বসে দিন-রাত সাউথ আফ্রিকা ভার্সাস ইন্ডিয়ার টেস্ট সিরিজ দেখতাম। অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলক, প্যাট সিমকক্স আর ল্যান্স ক্লুজনার বোলিং করে দিনভর, রাহুল দ্রাভিদ আর টেন্ডুলকার ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকায়। সেই আমলে জিম্বাবুয়ের কোচ ছিলো ডেভ হটন, ম্নাঠে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, হিথ স্ট্রিকদের কাঁপাকাপি ব্যাপার। সেই প্রাইমারি স্কুল টাইমে কয়জন এমন খেলা দেখতো জানিনা। তখন আমার একটা খাতায় পৃথিবীর যাবতীয় ক্রিকেট টিমের ১৪জন প্লেয়ারের নাম লেখা ছিলো। ১৯৯৪ সালে ক্লাস টু-থ্রিতে পড়লেও পুরো বিশ্বকাপের সব খেলা দেখেছিলাম। সাদা কাগজে সাইনপেন দিয়ে  ডিজাইন করে খেলার রেজাল্টগুলো সংরক্ষণ করেছিলাম। এইসব এখনো আমার কাছে আছে...



অনেক বছর পরে... ব্রাজিলের সাপোর্ট করলাম ২০০৬ ফুটবল বিশ্বকাপে। ফাইনালে যাওয়ার আগেই বাদ পড়ে গেলো তারা, আমার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে মন খারাপের চোটে একদিন পড়তেই বসতে পারলাম না। কয়েক মাস পরে বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ ছিলো যেন কোন দেশের সাথে, বাংলাদেশের পরাজয়ে কষ্ট পেয়ে হলের টিভি রুম থেকে বের হয়ে পথে-ঘাটে একা হাঁটাহাটি করলাম। প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে নয়, রূপসী নারীর ছলনায় হৃদয় ভেঙ্গে কষ্ট পেয়েও নয়, বরং যাকে সাপোর্ট করতাম খেলায়, তার পরাজয়ে এই কষ্ট-যন্ত্রণা। নিজের অন্তরের এই পরাজয়কে মেনে নিতে না পারায় সেদিন অতি দৃঢ় এক সংকল্প করেছিলাম। পরে বলছি তার কথা... এরপর টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট এলো। মাঠের সীমানায় আনুবীক্ষণিক পোশাক পরিহিতা চিয়ারগার্লদের উদ্ভব হবার পরে নিজেকে টিভি থেকে দূরে রাখার প্রতিজ্ঞা করতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি।

এখন খেলা হলে দু'চার বলের বেশি টিভির সামনে বসি না। এই অনর্থক কাজটা নেশার মতন--কয়েক বল দেখলে আরো দেখা হয়ে যাবে। খেলা যেখানে হয় তার সামনেও যাই না। তবে এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একমাস আগে আমি দেখেছিলাম খ্রিষ্টান মিলিশিয়ারা কীভাবে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে মুসলিমদের শরীরের উপরে ডিজে পার্টিমার্কা ড্যান্স দিয়ে হত্যা করছে। তিনদিন আগে আন্তর্জাতিক মিডিয়া (আসল ভয়াবহতার তুলনায় কতই না লঘু ছবি সেসব) প্রকাশিত সেই হত্যাযজ্ঞের ছবি দেখে আকুল হয়ে কাঁদলাম। থিসারা পেরেরা আর সোহাগ গাজীর লাঠি দিয়া বল বাইড়াবাইড়ির মিনিংলেস আলাপে-দর্শনে যখন গোটা তরুণসমাজ মশগুল, তখনো দুনিয়াজুড়ে হত্যা হয়ে চলেছে সিরিয়ান শিশুরা, কাশ্মীরী যুবক, মধ্য আফ্রিকায় অল্প কিছু মুসলিম ভাই, ফিলিস্তিনে মরছে কিশোর...

নিজ জীবনের সাথে নিষ্ঠুর কৌতুক মনে হয় এইসব নিস্ফল সময় নষ্টকারী 'এন্টারটেইনমেন্ট'। জীবনের যেই ছোট্ট সময়, তাতে এইসব আবর্জনায় বুঁদ হয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়ে আল্লাহর কাছে জবাব দেয়ার কিছু থাকবে বলে মনে করতে পারিনা। সবার জীবন জানিনা, আমি নিজে যত সময় দিয়েছিলাম খেলাধূলায়, আমি তার আফসোসেই মারা যাই। যদিও আমি কখনো স্প্যানিশ লীগ, লা লিগা, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লীগ দেখতে বসিনি। ভার্সিটির হলে থাকতেই এইসবকে নির্ভেজাল সময়-নষ্ট বলে মনে হতো।

আল্লাহ যেন আমাকে, আমাদের সবাইকে সময়ের উত্তম ব্যবহার করার তাওফিক দেন। আমাদের সময়ে যেন তিনি বারাকাহ দেন যাতে দুনিয়ার কাজ সেরে আখিরাতের জন্য পড়াশোনা, ব্যক্তিগত গোপন আমল এবং দাওয়াতের কাজ করতে পারি। সময় তো খুবই অল্প, সময় বয়ে যায়; অথচ কিছুই তো যেন জমাতে পারিনা আখিরাতের জন্য! আল্লাহই আমাদের সর্বোত্তম অভিভাবক, তিনি মেহেরবান এবং হিফাজতকারী। কেবল আল্লাহর কাছেই আমরা সাহায্য ও আশ্রয় চাই।

[১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে