১৬ ফেব, ২০১৪

অবাক ভালোবাসা


আমার জীবন থেকে আরেকটি বছরের আরেকটি 'ভালোবাসা দিবস' চলে গেলো। অনেক উদ্দামতা, অনেক যৌবনের তরঙ্গের সাক্ষী হয়ে রইলাম আবার। বন্ধুর কাছে শুনলাম, তার কলিগকে গত পহেলা ফাল্গুনে এবং 'ভ্যালেন্টাইন ডে' পালনের এই ১৩-১৪ ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজার যেতে হচ্ছিলো অফিসের কাজে। তিনি দু'দিনের যাত্রাপথে বহু কষ্টে ছুটে-ফিরে একটা সিট পেয়েছেন, এদিকে বাসস্ট্যান্ডে অনেক ভীড়, পর্যাপ্ত সিট নেই বাসে! 'ভালোবাসার' কামতরঙ্গ ছুটে এবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকেও ভাসিয়ে দিয়েছে হয়ত... আল্লাহই জানেন। বিগত বেশ কয়েক বছর থেকে এইসব দিনগুলোতে সম্ভব হলে ঘরেই থাকি, খারাপ লাগা আর অপছন্দনীয়তায়। এবারেও ছুটির দিন থাকায় তার ব্যতিক্রম হয়নি। মনে আছে, প্রায় দু'বছর আগে একটা লেখা লিখেছিলাম আমার পূর্বেকার জীবনের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম 'এর বেশি ভালোবাসা যায় না ও আমার প্রাণপাখি ময়না' শিরোনাম দিয়ে: http://idream4life.blogspot.com/2012/02/blog-post_7635.html


সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই হচ্ছে, হবেও। আমার বেড়ে ওঠার সময়টাতে নানান রকম পরিস্থিতি আর অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি যা উপলব্ধি করেছিলাম, তাতে বুঝেছিলাম, বেশিরভাগ পরিবারগুলোতে নেই আল্লাহভীতি, নেই ন্যুনতম বোধ যা জীবনকে সুন্দর, সহজ ও পারস্পারিক ভালোবাসাপূর্ণ করতে পারে। ঘরে-ঘরে স্যাটেলাইট কানেকশন, ফলে পৃথিবীর তাবৎ নোংরামি আর 'প্রেম-কাম' নিয়ে তৈরি মুভি-সিরিয়াল-গান দেখে বড় হওয়া প্রজন্মের কাছে সেই ফলাফলস্বরূপ হৃদয়ে 'ভালোবাসার' খরা চলে, কাঙ্গালের মতন তারা 'ভালোবাসার' জন্য ঘুরে বেড়ায়। এই 'ভালোবাসার ডেফিনিশান' বুঝার চেষ্টা আমার গোটা ছাত্রজীবনেই ছিলো, সেই অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলাম "সখী ভালোবাসা কারে কয়" : http://idream4life.blogspot.com/2011/08/blog-post.html

নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জাফর সাহেবদের মতন লোকেরা প্রেম করতে উৎসাহ দেয়; 'আইকন' হয়ে যাওয়া নরাধম লোকেরা প্রেমের দিকে ঠেলে দেন ঠিকই কিন্তু তার দায়-দায়িত্ব নেন না। বাকিটা নেয় বাবা-মা (বাধ্য হয়ে), এরপর খুন-আত্মহত্যা, ইন্টারনেটে ভিডিও ক্লিপ করে অন্তরঙ্গ মূহুর্ত শেয়ার করা চলতেই থাকে... আজকেই আমাদের খুব নিকটের পড়শির ঘরের খবর শুনলাম। সংবাদপাঠিকা হয়ে নতুন প্রেমে মজে গিয়ে সন্তানসহ ছাড়াছাড়ি করছেন, মামলা লড়ছেন সন্তান নিয়ে। আহা! 'ভালোবাসার' কী নিদারুণ দৈন্য! কয়েকদিন আগের পত্রিকায় পড়লাম ১০ বছর প্রেম করে বিয়ে করা সংসার ফেলে কক্সবাজারের হোটেলে আত্মহত্যা করলেন ডাক্তার মহিলা। কোন সে আজিব 'ভালোবাসায়' আমাদের সংসারগুলো গড়ছে, কীসে তার বিচ্ছেদ হচ্ছে --কে তার খোঁজ রাখছে!

আমার এক ছোট ভাই, খুবই ভালো ক্যারিয়ারসম্পন্ন ও 'মেধাবী' হলেও সে কিছুতেই বিশ্বাস করে না যে কোন মেয়েকে সে সারাজীবনের মতন বিশ্বাস করে কাছে টানতে পারবে। অথচ সে পূর্বেকার গার্লফ্রেন্ডের কাজিনের সাথে প্রেম করে 'ছ্যাক' দিয়ে 'এক্সের' উপরে শোধ তুলেছিলো। 'মেধাবী' এই ছেলেটা 'ক্যারিয়ার' ঠিকই এগিয়ে রেখেছে, কিন্তু তার অশান্ত-উত্তাল আর অস্থির অন্তরটার পাশে থেকে আমার বুক ধরফর করছিলো সেদিন অনেকক্ষণ। আমি জানি, এমন অশান্ত প্রাণ রয়েছে হাজারে-হাজারে, লাখে-লাখে যারা গুলো ঘুরে ফিরে কামের মাঝে, প্রেমের মাঝে ভালোবাসা খুঁজে নিতে চায়। কিন্তু এই 'ভালোবাসার' মরীচীকা তাদের আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়ায়। হয়ত এদেরকে সত্যিকার ভালোবাসার সাথে পরিচয় হয়নি, হয়ত তাদের সামনে বার্তা যায়নি কখনো।

ছাত্রজীবনে অনেককে চিনতাম যারা নামাজে নিয়মিত ছিলো, তাদের অনেকেই ধীরে ধীরে প্রেম-নারী-ভালোবাসার বিভ্রমে হারিয়েই গিয়েছে। চেনাজানাদের বলে-কয়ে ফেরাতে পারিনি, মনে হয় তখন নিজেও তেমন বুঝতাম না। খারাপ লাগতো, যে একবার এই শয়তানী 'ভালোবাসার মায়াজালে' আটকেছে, সে সচরাচর আর ফেরেনি স্বাভাবিক শান্তির জীবনে। একের পর এক সম্পর্ক আর বিচ্ছেদ, প্রেম-ডেটিং-চ্যাটিং-কলিং-ব্রেকাপের অদ্ভুত এক অশান্তির চক্র!! চারপাশের কথা বলতে গিয়ে আবার নিজের কথাই মনে হয়... আমি আল্লাহর অপার রাহমাতপ্রাপ্ত, তাই হয়ত এভাবে বুঝতে শিখেছি; নইলে আমার এই যিন্দেগিতে চারপাশের 'peer-pressure' আমাকেও তো কম ভোগায়নি! তাই সেই উপলব্ধি ঘুরে ফিরে প্রকট হয়ে গেঁথে থাকে বুকে -- আল্লাহই আমাদের একমাত্র হিফাযতকারী।

আমি যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যে সামাজিক পরিবেশে বড় হয়েছি, তাতে এমন অশান্তির প্রসার দেখে চেষ্টা করতাম কীভাবে কিছুটা হলেও শান্তির বাতাস বইয়ে দেয়া যায়। ক্ষুদ্র জ্ঞানে আর অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে, খুব বেশি প্রয়োজন হালাল সম্পর্ক বিয়ের কথা প্রচার ও প্রসার করা। প্রয়োজন সমাজের বানানো কঠিন বিয়েকে সহজ করে দেয়ার চেষ্টা করা। খুব প্রয়োজন আল্লাহ আমাদেরকে এত সুন্দর ভালোবাসা চিনিয়েছেন তার স্বরূপকে তুলে ধরা। সব ভালোবাসা যখন কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়, তখন যে তা যাবতীয় পার্থিব ক্ষুদ্রতাকে ছাপিয়ে কেবল সৌন্দর্য আর শান্তির আনয়নকারী হয় --সেই বোধটাও ছড়িয়ে দেয়া দরকার।

আল্লাহকে জীবনের কেন্দ্রে আনলে যে জীবন সহজ হয়ে যায়, আল্লাহর উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করে তার কাছে তিনিই যে আমাদেরকে উদ্ধার করে দেন অভাবগুলো থেকে, সেই বোধটা আগে নিজেদের মাঝে স্থাপন করে তারপর আশেপাশে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা দরকার। সংস্কৃতির নামে নোংরামি আমাদেরকে কোন ধ্বংসের মঞ্জিলে যে নিয়ে যাচ্ছে, তা পত্রিকার পাতাল উলটালেই কিছুটা বুঝা যায়।

আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের পরিবারকে ও আমাদের সমাজকে রক্ষা করুন। আল্লাহ আমাদেরকে তাকে ভালোবাসার, আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার, আল্লাহকে যারা ভালোবাসেন তাদেরকে ভালোবাসার এবং আল্লাহকে যারা ভালোবাসেন তাদের ভালোবাসা পাওয়ার তাওফিক দিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে