৬ মে, ২০১৫

বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠা (দ্বিতীয় পর্ব) : শরীরের সচেতনতা


ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকলেই অনেকে অন্ধকার পছন্দ করতে শুরু করে। কম-কম খায় কেননা খাওয়ায় অরুচি হয়। কিছুতেই ভালো লাগে না বলে পারলে অন্ধকার ঘরের কোণার দিকে পড়ে থাকে। এই অভ্যাস একসময় মানুষকেই দখল করে ফেলে। ডিপ্রেশনই তখন মানুষটাকে কন্ট্রোল করতে শুরু করে।

ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির জন্য অনেকে অনেক কিছু বলে। সত্যিকার অর্থে, ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে প্রথমেই দরকার নিজের ইচ্ছা হওয়া। আপনি যখন নিজেকে বিষণ্ণ রূপে দেখতে অপছন্দ করবেন, তখনই আপনার নিজেকে আপনি প্রথম সাহায্যটি করবেন। 

গুটিয়ে পড়ে থেকে কী লাভ? প্রকৃতপক্ষে, আপনার দুর্দশায় অন্য কারো তেমন কিছুই আসে যায় না। আপনি বিষণ্ণতায় কেমন রকমের কষ্টে ভুগছেন তা অন্যেরা চাইলেও অনুভব করতে পারবে না তাই কাউকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। আপনার নিজেকে নিজেরই সাহায্য করতে হবে। অন্য কেউ আপনাকে টেনে তুলবে না কখনই। এই আশা করাও ভুল, অনুচিত এবং বোকামি। তাছাড়া, আল্লাহ রব্বুল আ'লামীন তাদেরই সাহায্য করেন যারা নিজেদের সাহায্য করে। আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টিই 'সিস্টেমেটিক' উপায়ে চলছে, সেগুলো একটা ছন্দের মধ্যে আবর্তিত। তাই, আপনাকে নিজের সুদিন বয়ে আনতে প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি তৈরি করতে হবে নিজের ভেতরে। 

প্রতিজ্ঞা করুন, যেকোন উপায়ে আপনি আপনার মাঝে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনবেন। এরপর আরো যেসব পদক্ষেপ আপনাকে সাহায্য করতে পারে সেগুলো হলো--

(১) জীবন থেকে আলসেমি দূর করুন। যে কাজগুলো করা দরকার, সেগুলো নিজে করুন। সম্ভব হলে অন্যদের কাজও করে দিন। শরীরকে কাজ দিন। কাজ করে ঘেমে উঠুন, তারপর গোসল করে নিজেকে 'ফ্রেশ' ফিলিং দিন।

(২) পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি থাকুন। আপনি যে ঘরে থাকেন, যে বিছানায় ঘুমান, যে টেবিলে বসেন তা পরিপাটি করে রাখুন। নিজেকে 'ফ্রেশ' ফিলিং দিন। সুন্দর ঘর, সুন্দর বিছানা আপনার মনের মাঝে একটি সুন্দর প্রতিচ্ছবি তৈরি করবে। এই ভালোলাগার 'গিয়ার' ধরে আপনি আপনাকে সামনে এগিয়ে নিতে কাজ করুন।

(৩) মজা করে খাওয়া দাওয়া করুন। নিজের প্রিয় মেনু খাওয়ার চেষ্টা করুন। নিজেকে 'ট্রিট' দিন। ডিপ্রেশনে ভুগলে অরুচি তৈরি হয়, অরুচির কারণে খাওয়া কম হয়, এর প্রভাব পড়ে ব্রেইনে। ঝিম-ঝিম ভাব, নিঃস্পৃহ ভাব তৈরি হয়। তাই আগ্রহ করে খান, এবং আগ্রহ করে কাজ করুন। 

(৪) ভালোকাজ করুন, পরোপকার করুন। অন্যদের সাহায্য করতে কাজ করুন। অন্যদের কাজে যারা লাগে, যারা অন্যদের অভাব পূরণে এগিয়ে যায়, আল্লাহ তাদের  অভাব পূরণ করে দেয়। আপনি নিজেকে অন্য কারো হাসিমুখ হবার কারণ হিসেবে তৈরি করুন। মনে রাখবেন, আপনার হাসিমুখ কিন্তু একটি সাদাকাহ।

(৫) আলোকময় ঘরে থাকুন। অন্ধকার থেকে দূরে থাকুন। অন্ধকার হলো কালো, আলোর বিপরীত অন্ধকার। সত্য হলো নূর। আল্লাহ হলেন নূর। ঈমানের দীপ্তি হলো আলোকময়। আলো হলো ইতিবাচকতা, অন্ধকার হলো নেতিবাচকতা। তাই আলোকে পছন্দ করুন। ঘরে উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা করুন। সূর্যের আলো যেন ঘরে ঢুকে এমন ব্যবস্থা করুন সম্ভব হলে।

(৬) শরীরচর্চা করুন, খেলাধূলা করুন। নিজেকে কাজ দিন। প্রতিদিন সকালে ও বিকালে অবশ্যই সূর্যালোকে হাঁটুন, খেলাধূলা করুন। বাইরের বাতাসের স্পর্শ দিন নিজ শরীরকে।

(৭) সচেতনভাবে শরীরকে ব্যস্ত রাখুন, মনকেও। যখন নড়াচড়া করবেন, গা এলিয়ে নড়বেন না। সচেতনভাবে নড়াচড়া করুন। আলসেমি বা যাচ্ছেতাইভাবে কোন কাজ করবেন না। হাঁটার সময় এমনভাবে হাঁটুন যেন স্টেজে হাঁটলে শত-শত দর্শক আপনাকে তাকিয়ে দেখলে আপনি যতটা সচেতন হয়ে হাঁটবেন সেভাবে সকল হাঁটা হয়। শরীরকে নিস্তেজ, এলোমেলো করে ছেঁচড়ে হাঁটবেন না। সচেতন হয়ে হাঁটুন। 

(৮) পরিমিত ঘুম। খুব বেশি ঘুম নয় আবার নির্ঘুম রাত নয়। রাতে সময়মতন শুয়ে পড়ুন যেন সকালে ফজরে ওঠা যায়, ফজরের পরে হাঁটাহাটি করা যায়। পরিশ্রম করুন দিনে যেন শরীর ক্লান্ত হয়ে রাতে এশা পড়েই ঘুমিয়ে যেতে পারেন।

(৯) অটো সাজেশন দিন নিজেকে। নিজেকে বুঝান, আপনি নিজের উন্নতি অর্জন করবেন অবশ্যই। আল্লাহ আপনাকে কী কল্পনাতীত শক্তি দিয়েছেন তা অনুভব করুন, নিজেকে সেই শক্তি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করুন। 

(১০) সলাতে নিয়মিত হোন। প্রতিদিনের ৫ ওয়াক্ত সলাত আমাদের জন্য শারীরিক, মানসিক, আত্মিক সমস্যার সমাধান করে। সলাত মানুষকে অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে দূরে রাখে, জীবনে শৃংখলা ফিরিয়ে আনে। সলাতের উপকার বর্ণনাতীত।

(১১) কুরআন তিলাওয়াত করুন। বিশেষ করে ফজরের সময় কুরআন  তিলাওয়াত অন্তরকে ও মনকে বিশেষ শক্তি ও প্রশান্তি দেয়। আল্লাহর বাণী পাঠ করার সময় নিজেকে অনুভব করান, যিনি আপনার স্রষ্টা তিনি ঠিক এই কথাগুলো আপনার জন্য বলেছেন। আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন কুরআনে আছে শিফা, অর্থাৎ আরোগ্য।

(১২) খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, অনর্থক-অর্থহীন-নিস্ফল চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন। চিন্তার অ্যানালাইসিস করে নিজেকে মানসিক প্যারালাইসিস রোগী বানাবেন না। মনকে এমন সব চিন্তা থেকে দূরে রাখুন যা আপনার বানানো দুশ্চিন্তা। আগে হতে দিন, তারপর সমস্যার মুখোমুখি হোন।

(১৩) বেশি বেশি ইস্তিগফার করুন। অনেক বিপদ আমাদের জীবনে আসে যা হলো আমাদের পাপের কারণে। আল্লাহ এর মাধ্যমে আমাদের সঠিক পথে আসার রিমাইন্ডার দেন, কষ্টগুলো দিয়ে পাপ পুড়িয়ে আমাদের মুক্ত করেন। কিন্তু পাপ করলে তৎক্ষণাৎ হাসানাহ তথা ভালো কাজ করা আমাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) উপদেশ। তাই বেশি বেশি ইস্তিগফার করুন এবং ভালো কাজ করুন। ইনশাআল্লাহ জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

পৃথিবীর মানুষদের জীবনকে জানতে চেষ্টা করলে দেখবেন আপনার সমস্যা আসলে খুব বেশি তীব্র নয়। প্রতিটি মানুষই নানান ঝামেলায়, কষ্টে থাকে। আল্লাহ অনেক জটিলতায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে রেখেছেন, তবু তারা দিব্যি যুদ্ধ করে যাচ্ছে ও সফল হচ্ছে। এসব থেকে অনুপ্রেরণা নিন এবং নিজেকে বুঝান, আল্লাহ আপনাকে শীঘ্রই খুব ভালো সময় দান করবেন ইনশাআল্লাহ। 

আল্লাহর নি'আমাত আমাদের শরীর। এর যথাযথ যত্ন নেয়া আমাদের দায়িত্ব। আল্লাহ যেন আমাদেরকে একটি উত্তম, শক্তিশালী, ঈমানে পরিপূর্ণ প্রোডাক্টিভ উম্মাহ গড়ে তোলার তাওফিক দেন যাদের উপরে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন এবং তারাও আল্লাহর উপরে সন্তুষ্ট হবে। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টাগুলো কবুল করুন এবং তাদেরকে জান্নাতলাভের উসিলা করে দিন। আমীন।

[০৬ মে, ২০১৫]

* * * * * * *
 # বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠা সিরিজের অন্যান্য লেখাগুলো পড়ুন: http://idream4life.blogspot.com/search/label/depression