২৪ মার্চ, ২০১২

আমাদের সমস্যা আধ্যাত্মিকতায়


"আমাদের সমস্যা হলো আধ্যাত্মিকতায়। যদি একজন মানুষ আমার সাথে মুসলিম বিশ্বে কী কী পুনর্গঠন করা প্রয়োজন সেই বিষয়ে কথা বলতে আসেন, অথবা রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে এবং অনেক বড় কোন ভৌগলিক কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে আসেন, তার প্রতি আমার প্রথম প্রশ্ন হবে তিনি ফজরের সালাত সময়মত আদায় করেছেন কিনা।" -- সাইদ রমাদান [১৯২৬-১৯৯৫]


সাইদ রামাদানের এই কথাগুলো পড়েছিলাম অনেকদিন আগেই। আমার কাছেও এই কথা অনেক বস্তুনিষ্ঠ মনে হয়েছে। আধ্যাত্মিকতার গুরুত্ব নিয়ে স্কলাররা বারবার বলে আসছেন দেখছি। এই বিষয় বর্তমান দিনগুলোতে আমার কিছু অনুধাবনকে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করবো।



দীর্ঘদিন যাবত চারপাশে বদলে যাওয়া বদলে দেওয়া টাইপের মুখভরা বুলি শুনেছি। কেউ এসব শ্লোগান দিয়ে ব্যবসা করে, কেউ সেটাকে পুঁজি করে সুযোগ গ্রহণ করে। বাস্তবিক জগতে কিছুই বদলায় না। অন্যদিকে আমাদের মুসলিম সমাজে, মুসলিম মানুষদের মাঝে দেশ সমাজ বদলে দেবার প্রত্যয় থাকে। সেই প্রত্যয় আল্লাহ জানেন যে অনেক গভীর ভালোবাসা থেকে উৎসারিত, স্বপ্নময়। কিন্তু সেখানেও খুব একটা পরিবর্তন আসে না। আমাদের সমাজের পরিবর্তন তো আর কেবল দুই চারজন মানুষের স্বপ্ন দেখা, জ্ঞান, পরিকল্পনার উপর নির্ভর করেনা। এটা একটা সামগ্রিক পরিবর্তন। সমাজের মুটে-মজুর থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই যখন বিনয়ী, সৎ, নিরহংকারী, নির্লোভী হবেন তখনই সেই সমাজে শান্তি আসতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে অনাচারের দুষ্টচক্র থেকে কেউই বের হন, দাসত্ব করতে থাকেন নিজের খায়েশের।

বলছিলাম বিশেষত মুসলিম সমাজের মানুষদের নিয়ে, যারা আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে নিজেদের বিলিয়ে দিতে রাজি থাকেন, যারা একটা সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখেন, প্রত্যয়ী থাকেন একটা বৈষম্যহীন শান্তিময় সমাজের। তারা অনেক পরিশ্রমের পরেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেন না। কেন পারেন না, সেই দেয়ার মালিক আল্লাহ। কিন্তু এখানেও আমাদের চিন্তা করার কিছু খোরাক আছে। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিষ্ঠিত সমাজে মাত্র তিন লক্ষ সৈন্যের বিপরীতে দশ লক্ষ রোমান সৈন্যরা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। ৩১৩ জনের সেই ঈমানের জোরের কাছে তো কখনই দাঁড়াতে পারেনি মুশরিকদের কলুষ পা গুলো। তাদের ছিলো ঈমানের বল -- যেই ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু মাঝরাতে রাস্ট্রীয় গুদাম থেকে আটা কাঁধে করে পৌঁছে দিয়েছিলেন অর্থসংকটে থাকা এক মায়ের ঘরে। 

সাহাবা আজমাঈন, তাবেঈনগণ তাযকিয়াতুন নাফস এর উত্তম উদাহরণ। আত্মার পরিশুদ্ধির প্রচেষ্টায় তারা ছিলেন অন্তপ্রাণ। তাদের আমল ছিলো সুন্দর। সেই নামাযের গল্প আমরা প্রায় সবাই জানি যে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে শত্রুরা তীরবিদ্ধ করলে সেটিকে খোলা যাচ্ছিলো না কারণ তিনি চিতকার করছিলেন কেউ তাতে হাত দিতেই। তাই তিনি যখন নামাযে দাঁড়ালেন, নামাযে এতটাই তন্ময় হয়েছিলেন যে তার পায়ে বিদ্ধ তীরটি সহজেই খোলা গেলো। এতটাই সুন্দর ছিলো তাদের সেই আধ্যাত্মিক শক্তি। এই আধ্যাত্মিকতা আল্লাহর প্রেমে, আল্লাহর ভয়ে অর্জিত। এই শক্তিই মুমিনের শক্তি। লক্ষ্য অর্জনে অটুট, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। জাগতিক চাওয়া-পাওয়া যেই মানুষদের স্পর্শ করেনা। তারা অযথা সময় নষ্ট করেন না। তারা পার্থিব সুবিধাভোগের জন্য বিকিয়ে দেন না নিজেদেরকে।

আমাদের দরকার এই আধ্যাত্মিকতা। আমাদের দরকার ঈমানের এই জোর। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার সাথে দরকার সুমধুর সম্পর্ক। এই সম্পর্ক অর্জিত হবে আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে। আমাদের আলোচনায় যখন থাকবেন আল্লাহর রাব্বুল আলামীন, রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আমাদের ভালোবাসায় যখন তাঁরা থাকবেন, আমাদের একাকীত্বে যখন আল্লাহর স্মরণে কাটবে আমাদের হৃদয়। কেউ যখন দেখবেনা তখন আল্লাহ দেখছেন ভেবে যখন আমরা বিরত থাকবো আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ থেকে -- সেটাই হলো একজন মুসলিমের প্রকৃত সফলতা অর্জনের পথ। আর এই মানুষটার চিন্তাতে, কাজে, মেধায় ও পরিকল্পনায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা যে বারাকাহ দান করবেন -- সেটাই তো স্বাভাবিক।

আমাদের সফলতা অর্জনের পথে তাই আধ্যাত্মিকতা গুরুত্বপূর্ণ, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ক'জন মানুষ অমন সুন্দর করে নামায পড়তে পারেন। আমাদের ক'জন প্রতিরাতে তাহাজ্জুদে পাবন্দী করেন? আমাদের ক'জন তাদের আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছ, নিয়মিত যাকাত দেন। ক'জন অতিরিক্ত বিলাসিতাকে সজ্ঞানে পরিহার করেন হযরত উমারের মতন। আমরা যদি ইসলামের স্তম্ভের মূল এই ঈমান, সালাহ, সাওম, যাকাহ আর হজ্বের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন হই -- আমাদের সমাজ যখন এরকম নরশার্দুল পাবেন, তখন আমাদের সমাজের কলুষতা, নোংরামি বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। আমাদের সমাজে স্থাপিত হবে ন্যায়বিচার, সততা।

আল্লাহ আমাদের সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। আমাদের ঘুণেধরা সমাজের ছাঁচ হিসেবে দ্বীন আল ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া কবুল করে নিন। আল্লাহ আমাদের সেই দলের অন্তর্ভুক্ত করে দিন -- যাদেরকে দেখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নিজ উম্মাহ হিসেবে পরিচয় দিতে আনন্দবোধ করবেন। আল্লাহ আমাদের লেখনীর ও চিন্তার ভুলত্রুটি ক্ষমা করে কবুল করে নিন।

সাইদ রামাদানের পরিচিতিঃ

সাইদ রামাদান [১৯২৬-১৯৯৫] ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হাসান আল বান্নার জামাতা। তার সহধর্মিনীর নাম ওয়াফা আল বান্না। সাইদ রামাদান মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি একনায়ক শাসক জামাল আব্দুন নাসেরের শাসনামলে মিশর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি সৌদি আরবে চলে গিয়েছিলেন যেখানে তিনি, "ওয়ার্ল্ড ইসলামিক লীগ" নামের একটি চ্যারিটি এবং মিশনারী গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় চলে যান সেখানে ১৯৬১ সালে তিনি "ইসলামিক সেন্টার ইন জেনেভা" প্রতিষ্ঠা করেন যা একটি মসজিদ এবং কমিউনিটি সেন্টার সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং যেখানে রয়েছেন একদল থিঙ্ক ট্যাংক। সাইদ রামাদানের ছেলে হানি রামাদান বর্তমানে এই সেন্টারটির দেখাশোনা করছেন। সাইদ রামাদানের অপর ছেলের নাম তারিক রামাদান, যিনি নামকরা ইসলামিক স্কলার এবং বর্তমানে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কনটেমপোরারি ইসলামিক স্টাডিজের প্রফেসর।

সূত্রঃ
১| সাইদ রামাদান উদ্ধৃতি
২|
উইকিপিডিয়াঃ  সাইদ রামাদান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে