২৪ অক্টো, ২০১১

তারিক রামাদানঃ এক অনুপ্রেরণা আর মুগ্ধতার নাম


তারিক রামাদান নামটার সাথে আমার পরিচয় বছরখানেক হবে। একটা বক্তব্য দেখেছিলাম যেটা তিনি মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন (এমএসএ) আয়োজিত একটা অনুষ্ঠানে রেখেছিলেন। অসম্ভব মুগ্ধতায় ভরে গিয়েছিলো আমার মন। তারপর খুঁজে পেতে পেলাম আলজাজিরা টেলিভিশনে রিজখান শো তে দেয়া একটা সাক্ষাতকার। বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে তারিক রামাদানকে প্রশ্ন করে বিব্রত করা হয়। এই প্রশ্নগুলো আমি আরো অনেকজনকে ঘায়েল হয়ে যেতে দেখেছি জীবনে — কিন্তু প্রফেসর রামাদান সেগুলো তার জ্ঞানের গভীরতা, প্রজ্ঞা দিয়ে নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছিলেন।

তারপর থেকেই তার ব্যাপারে পড়াশোনা শুরু। তার সম্পর্কে জেনে অনুপ্রাণিত হয়েছি, শ্রদ্ধাবনত হয়েছি। তার একাডেমিক ক্যারিয়ার সমীহ করার মতন সৌন্দর্য্যময় আর অসাধারণ। সবচাইতে বড় কথা, একজন মুসলিম হিসেবে নিজেকে মনে করার পরে আমি আর এরকম একাডেমিশিয়ান এবং স্কলার হিসেবে উনাকেই প্রথম পেয়েছিলাম যার চিন্তাধারা আর উপস্থাপনা অত্যন্ত ডাইন্যামিক। ইসলামের উসুলের উপর তার গভীর জ্ঞান, দর্শন আর সাহিত্য মিলিয়ে তার লেখনী, বক্তব্যে যুক্তি, বিশ্বাস আর উপস্থাপনা হয় প্রাঞ্জল, প্রেরণাময়, সুন্দর, শিক্ষণীয় ও উপভোগ্য।

সুইজারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী তারিক রামাদান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কনটেমপোরারি ইসলামিক স্টাডিজের প্রফেসর। তিনি জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ করেছেন দর্শন এবং ফরাসি সাহিত্যে; ডক্টরেট করেছেন অ্যারাবিক এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ এ ইউনিভার্সিটি অফ জেনেভা থেকে। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের টাইম ম্যাগাজিনের জরীপে বিশ্বের সেরা ১০০ জন বিজ্ঞানী এবং থিঙ্কারের তালিকায় তারিক রামাদান রয়েছেন।
প্রফেসর তারিক রামাদান কায়রোর আল আজহার ইউনিভার্সিটির স্কলারদের কাছ থেকে ক্লাসিক ইসলামিক স্কলারশিপে ওয়ান-অন-ওয়ান ইনটেনসিভ ট্রেনিং নিয়েছেন। যেই ট্রেনিং-এ গড়ে ৬-৭ বছর লাগে, তারিক রামাদান অসাধারণ নৈপুণ্য আর জ্ঞানের মাধ্যমে তা ২ বছরে সম্পন্ন করেছিলেন। একটা সাক্ষাতকার থেকে জানা যায় যে তিনি আল-আজহারে অধ্যয়নকালে সকাল সাড়ে ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত লাগাতার পড়াশোনা করতেন।
তারিক রামাদানে ইউরোপের মুসলিমদের এক অনুপ্রেরণা। নন-মুসলিমদের কাছ থেকে বিভিন্ন কঠিন ও আক্রমণাত্মক ইস্যুতে মুসলিমদের পক্ষে তার কণ্ঠ একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অংশগ্রহণ। তিনি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলেন মুসলিমদের অবস্থান, দ্বায়িত্ব আর কর্তব্যগুলো। তার অসাধারণ বাকপটুতা মুগ্ধ করার মতন। নিজের সম্পর্কে একবার তিনি বলেছিলেনঃ "আমি জাতীয়তায় সুইস, ধর্মে মুসলিম, স্মৃতিতে মিশরীয়"। এই তিনের মিশ্রণ তার ব্যক্তিত্বকে আকর্ষণীয় করেছে।

তারিক রামাদানের একটি উদ্ধৃতি আমার খুব পছন্দেরঃ
“There is no religion without culture, there is no culture without religion but religion is not culture.”
"ধর্ম ছাড়া কোন সংস্কৃতি নেই, সংস্কৃতি ছাড়া কোন ধর্ম নেই, কিন্তু ধর্ম কোন সংস্কৃতি নয়" — তারিক রমাদান

তারিক রামাদান সম্পর্কে বলতে গেলে ছোট কলেবরে বলা সম্ভব নয়। তার কাজের ও জ্ঞানের পরিধির উপরেও ওভারভিউ দেয়াও একটা যোগ্যতা ও প্রচেষ্টার ব্যাপার। হয়ত কেবল চোখ বুলিয়ে নেয়া যেতে পারে এই জীবনীতে। সংক্ষিপ্ত কলেবরে যতটুকু সম্ভব তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

তারিক রামাদানের সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ
তিনি জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ করেছেন দর্শন এবং ফরাসি সাহিত্যে; ডক্টরেট করেছেন অ্যারাবিক এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ এ  ইউনিভার্সিটি অফ জেনেভা  থেকে। তিনি দীর্ঘদিন সুইজারল্যান্ডের ফ্রেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ ও দর্শন বিভাগে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। তারিক রামাদান কায়রোর আল আজহার ইউনিভার্সিটির স্কলারদের কাছ থেকে ক্লাসিক ইসলামিক স্কলারশিপে ওয়ান-অন-ওয়ান ইনটেনসিভ ট্রেনিং নিয়েছেন।
তারিক রামাদান ১৯৬২ সালে জেনেভায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রামাদান সাইদ রামাদান এবং ওয়াফা আল বান্নার সন্তান। ওয়াফা আল বান্নার পিতা ছিলেন হাসান আল বান্না যিনি ১৯২৮ সালে মিশরের নন্দিত ইসলামি সংগঠন ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ প্রতিষ্ঠা করেন। অত্যাচারী জামাল আবুল নাসের সরকার তারিক রামাদানের পিতাকে মিশর থেকে নির্বাসিত করেন। সাইদ রামাদান পরিবার সহ সুইজারল্যান্ডে চলে যান যেখানে তারিক রামাদানের জন্ম হয়। তারিক রামাদানের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে যে পারিবারিক প্রভাব পড়েছে তা বলা যায় বেশ সহজেই।

তারিক রামাদান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কনটেমপোরারি ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক (ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউট, সেন্ট এন্টনি কলেজ)। সেই সাথে তিনি অক্সফোর্ডের ফ্যাকাল্টি অফ থিওলজিতে শিক্ষাদান করেন। একইসাথে তিনি কাতার (ফ্যাকাল্টি অফ ইসলামিক স্টাডিজ) এবং মরোক্কো (মুন্দিয়াপোলিস) তে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দ্বায়িত্বপালন করছেন। সেই সাথে জাপানের কিয়োটোর দোশিশা ইউনিভার্সিটিতে তিনি সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করছেন।
প্রফেসর তারিক রামাদান বর্তমানে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের ইউরোপিয়ান থিঙ্ক ট্যাংক — ইউরোপিয়ান মুসলিম নেটওয়ার্ক (ইএমএন) এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্তব্য পালন করছেন।
উল্লেখ্য, তিনি মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সালে ক্লাসিক্স ডিপার্টমেন্টের ইসলামিক স্টাডিজ এর অধ্যাপক পদ এবং রিলিজিয়ন, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড পিস-বিল্ডিং এ হেনরি আর লিউস প্রফেসর পদ অধিকার করেন। বুশ নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন তার ভিসা প্রত্যাহার করলে তিনি এই দু’টো পদ প্রত্যাহার করেন। ওবামা প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর তার উপর এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে আমেরিকা।
তিনি ২০টি’র অধিক বই ও ৭০০টির অধিক প্রবন্ধের লেখক বা সহ লেখক। বিশ্বের ইসলামি পুনর্জাগরণে বিশেষ করে পাশ্চাত্য ও সমকালীন বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কিত তর্ক-বিতর্কে লেখা এবং বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, রাখছেন। তিনি একাডেমিক লেকচার ছাড়াও বিশ্বজুড়ে তৃণমূল পর্যায়েও বক্তৃতাদান করে থাকেন। তার আলোচনার বিষয়ে থিওলোজি, ইসলামিক আইন এবং বিচার, অ্যাপ্লাইড এথিকস, সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইন্টারফেইথ এবং ইন্ট্রাকমিউনিটি ডায়ালোগ।
২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের টাইম ম্যাগাজিনের জরীপে বিশ্বের ১০০জন বিজ্ঞানী এবং থিঙ্কারের তালিকায় তারিক রামাদান রয়েছেন। ২০০৯ সালে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের অনলাইন ভোটে তারিক রামাদান সমসাময়িক ১০০ জন সেরা ইন্টেলেকচুয়াল তালিকায় ৪৯তম অবস্থান পেয়েছিলেন।

তথ্যসূত্রঃ

২টি মন্তব্য:

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে