১ সেপ, ২০১১

চলে যাওয়া মায়ের প্রতি সন্তানের সে চিঠি







গত বেশ কিছুদিন যাবত একটা বই পড়ছি। বইটা পড়তে পড়তে মুগ্ধতা আমাকে দ্রবীভূত করে ফেলছে। এই কথাটা এজন্যই বললাম যে আমার প্রতিদিন মনে হয় -- এই বই পড়ে আমার অনুভূতিরা আজ দৈন্যতা মুক্ত হলো, এই ভালোলাগারা আমার মন, চিত্ত আমার ভাবনার রাজ্যকে ভালোলাগায় ডুবিতে তাতে আমাকে সেট করে দিচ্ছে। আর তাই "দ্রবীভূত" শব্দটা ব্যবহার করলাম। বইটার নাম হলো "আল কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য"। আরবি ভাষায় লিখিত "আত তাসবীরুল ফান্নী ফিল কুরআন" নামের এই বইটির বঙ্গানুবাদ পড়ছি আমি। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছি আসল স্বাদ আর প্রকাশভঙ্গির কেবল বহুদূর দিয়েই যাবে কথাগুলো। তারপরেও আমি যা পাচ্ছি, তা অবিশ্বাস্য! লেখক আরবি সাহিত্যের একজন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উঁচুস্তরের সাহিত্যিক এবং অমর কথাশিল্পী ছিলেন। তিনি হাফেজে কুরআন ছিলেন এবং আল-কুরআনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী গবেষক। সাইয়েদ কুতুব রহিমাহুল্লাহ ছিলেন আরবি সাহিত্য, শিল্পকলা, ললিতকলাতে বিশেষ পারদর্শী-- আর তাই তিনি পবিত্র কুরআনকে দেখেছিলেন এক অন্যরকম মাত্রায়। এই মাত্রাটির সাথে আমরা (বিশেষ করে আমি) সচরাচর পরিচিত নই। কিন্তু আল কুরআনুল কারীমের সীমাহীন শ্রেষ্ঠত্বের এক অসামান্য অংশ জুড়ে আছে তার শৈল্পিক সৌন্দর্য। বইটি আমি পড়ে শেষ করিনি, কিন্তু একটা দারুণ জিনিস অনুভব করেছি -- তা হলো কুরআনের আলোচনায় সৃষ্ট দৃশ্যকল্প। হোক সে নবী-রাসূলের সময়ে বর্ণনা বা গল্পগুলো -- হোক সে কিয়ামাহ, হাশরের ময়দানের বর্ণনা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কী অপার শিল্পকলায় তা আমাদের কাছে, মনকে স্পর্শ করে তাকে অনুভব করার মতন করে বর্ণনা দিয়েছেন সেই ব্যাপারটাই আমি বুঝছি নতুন করে। জাযাকাল্লাহু খাইরান যালিম শাসকের হাতে শহীদ হওয়া এই লেখককে এবং বইটির অনুবাদককেও-- যিনি একটা 'থ্যাঙ্কলেস জব' করে আমার মতন ক্ষুদ্র আত্মাকে চিন্তার এক ভিন্ন মাত্রাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করলেন।



আমি বইয়ের ভিতরের কিছু বলবো ভেবে লিখতে বসিনি। আমি আজ হঠাৎ বইয়ের শুরুতে গিয়ে acknowledgment তথা "নিবেদন/উৎসর্গ" পাতাটি পড়ছিলাম। সাইয়েদ কুতুব তার মায়ের মৃত্যুর পরে বইটি লিখেছিলেন আর তিনি বইটিও তার মা কে উৎসর্গ করেছিলেন। পড়তে গিয়ে আমার চোখ ভিজে এসেছে কয়েকবার। একজন মায়ের ভূমিকা ভেসে এলো চোখে। একজন সন্তানের কথা ভেসে এলো চোখে, আমার অনুভবে। একজন মায়ের রূপ আমার মনে ভেসে এলো -- ভেসে এলো আমার নিজের মায়ের কথা। আর তাইতো চলে যাওয়া সেই মায়ের প্রতি সন্তানের এই চিঠিটাই আমাকে খুব করে নাড়া দিয়ে গেলো। বইটির "নিবেদন" পাতায় লেখা লেখকের কথাগুলো আমি তুলে দিচ্ছি।


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

মুহতারামা আম্মা! আমি এই বইটিকে আপনার নামে উৎসর্গ করছি।

প্রিয় মা আমার! স্মৃতিপটে একটা কথা আমার এখনো জ্বলজ্বল করছে -- প্রতিটি রামাদান মাস এলে ক্বারী সাহেব আমাদের ঘরে এসে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা তা কান লাগিয়ে পর্দার আড়াল থেকে তন্ময় হয়ে শুনতেন। যখন আমি শিশুসুলভ চিৎকার জুড়ে দিতাম তখন আপনি ইঙ্গিতে আমাকে চুপ করতে বলতেন। তখন আমিও আপনার সাথে কুরআন শুনতে শরীক হয়ে যেতাম যদিও তখন আমি তা অনুধাবন করার মতন সক্ষম ছিলাম না। কিন্তু শুনতে শুনতে কুরআনের আক্ষরিক উচ্চারণগুলো আমার হৃদয়ে গেঁথে যেতো, মনে বদ্ধমূল হয়ে যেতো। তারপর আমি যখন আপনার হাত ধরে হাঁটতে শিখলাম তখন আপনি আমাকে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। আপনার খুব ইচ্ছে ছিলো আল্লাহ যেন উনার কালামকে কন্ঠস্থ করার জন্য আমার হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেন। অবশ্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাকে খুশ ইলহানের মতন নিয়ামাত দান করেছেন। যেন আমি আপনার সামনে বসে প্রায় সময় তা তিলাওয়াত করতে পারি। আমি পূর্ণ কুরআন হিফজ করে নিলাম। আপনার আকাঙ্ক্ষার একটি অংশ তো পূর্ণ হয়ে গেলো!

প্রিয় আম্মা আমার! আজ আপনি আমার ধরা-ছোয়ার বাইরে। কিন্তু আপনি রেডিও সেটের কাছে বসে যেভাবে ক্বারী সাহেবের তিলাওয়াত শুনতেন - আপনার সেই ছবি আমার স্মৃতিপটে অম্লান। তিলাওয়াত শ্রবণরত অবস্থায় আপনার মুখে যে সুন্দর ও পবিত্র রূপ ধারণ করতো, আপনার হৃদয়-মনে তার যে প্রভাব পড়তো -- সে স্মৃতি আজো আমার স্মৃতিতে অম্লান।

ওগো আমার জন্মদাত্রী! আপনার সেই মা'সুম শিশুটি আজ নওজোয়ান যুবক। আপনার সেই চেষ্টার ফসল আজ আপনার নামে নিবেদন করছি। আল্লাহ যেন আপনার কবরের ওপর ভোরের শিশিরের মতো শান্তি অবতীর্ণ করেন এবং আপনার সন্তানকেও যেন মাহফুজ রাখেন।

আপনার সন্তান,
সাইয়েদ কুতুব।




এই লেখাটা পড়ে অনেক কথা মনে পড়ে গেলো আমার। আমার মা আমার ছেলেবেলায় অনেক সূরা আর অনেক দোয়া শিখিয়েছেন। আমাকে জোর করে বসিয়ে রেখে নয়! সেই ছোট্টবেলায় আম্মু আমাকে নিয়ে খেলতেন যখন, তিনি আপনমনে তিলাওয়াত করতে থাকতেন। মায়ের কন্ঠে শোনা সেই সুরা আর তার অংশগুলো আজো উনার মতন করেই আমি পড়তে পারি, তার তিলাওয়াতের সুর আমি হুবহু অন্তরে গেঁথে রেখেছি। আমি জানি, আমি জীবনে অনেকবার এলোমেলো অনেক ভুল কাজে চলে যেতে নিয়েছি, আমার মায়ের পবিত্র মুখটা আমার জন্য ম্লান হয়ে যাবে ভাবলেই আমি আর আগাতে পারিনি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। হয়ত অমন মায়ের সন্তান হয়ে জন্মেছিলাম বলে আজ গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়াদের দলে নই। আমার মা'কেও আল্লাহ যেন জান্নাতের শান্তি দান করেন কবরে যখন তিনি সেখানে যাবেন। আমার মা আমাকে যেমন করে চেয়েছিলেন, অমন সুন্দর আত্মার আমি হতে পারিনি! আল্লাহ আমাদের আদর্শ সন্তান হবার তৌফিক দান করুন, আমাদের মায়েদের অনেক অনেক সুন্দর হবার তাওফিক দেন যেমন সুন্দর আল্লাহর প্রিয় মানুষেরা হয়ে ত্থাকেন। আমাদের মায়েদের দেই পবিত্র, সুন্দর আর অপরূপ ভালোবাসার স্পর্শে -- তাদের সৌন্দর্যমন্ডিত আত্মার সান্নিধ্যে আমাদের মতন সন্তানেরা সুন্দর হয়ে গড়ে উঠুক। এই দুয়া আমাদের সবার।

মহান আর সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে বিনীত প্রার্থনা করতে পারাও আমাদের জীবনের একটা প্রাপ্তি! যিনি এই বিশ্বজগতের মালিক, তিনি যেন আমাদের করুণাধারায় সিক্ত করে আমাদের মুক্তি পাওয়া বান্দাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। আমিন।

৫টি মন্তব্য:

  1. হয়ত অমন মায়ের সন্তান হয়ে জন্মেছিলাম বলে আজ গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়াদের দলে নই।

    উত্তরমুছুন
  2. @ণূরে আলম মাসুদঃ খুব ভালো লাগলো জেনে

    @রহস্য বালিকাঃ অনেক ধন্যবাদ :)

    উত্তরমুছুন
  3. একটা কথা আজকাল প্রায়ই মনে হয়, আরবী ভাষাটা সকল মুসলিমের জন্য যেভাবে শেখাটা প্রয়োজন তার কিছুই হচ্ছে না।
    চমৎকার লিখেছেন।

    উত্তরমুছুন

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে