১৭ জুন, ২০১৫

রোযার মাস নিয়ে পরিকল্পনা

এই লেখাটি লেখার ইচ্ছা ছিলো না একদম। আমি মনে করিনা রামাদান মাসের পরিকল্পনা শীর্ষক লেখা লিখে তা ছড়ানোর মতন ন্যুনতম যোগ্য মানুষ আমি। কিন্তু কয়েকজন প্রিয় ছোট ভাই রমাদান পরিকল্পনা সংক্রান্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছিলো কিছুদিন যাবত এবং আমি তখন উত্তর দিতে ক্রমাগত লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমি মনে করিনা আমার পরিকল্পনা আদৌ তেমন লেখার মতন। তবুও লিখছি, মূলত 'চলমান রামাদান প্ল্যান ও টিপস' বিষয়টি নিয়ে...



আসলে খেয়াল করে দেখেছি, অনলাইন জগত আর অফলাইন জগতের ক্ষেত্রে রামাদানের আগের মাসের বিষয়গুলোতেও বিস্তর পার্থক্য। আগেও আমাদের জীবনে রামাদান আসতো প্রতিবছর-- তখন জুমু'আর খুতবায়, বিভিন্ন ওয়াক্তের শেষে ইমাম সাহেবদের কন্ঠে প্রস্তুতিমূলক 'আমলপূর্ণ' রিমাইন্ডারগুলো বুকে আলোড়ন জাগাতো অনেক বেশি। ঝাঁকি দিয়ে আগানো হত। হয়ত খুব স্কলারলি আলাপ না, আজহারি, দেওবন্দি, মাদানি আলেমদের আলাপ নয়, তবুও তখন যা হতো, জীবনে তার প্রভাব থাকতো গভীর; এখনকার ইন্টারনেট-স্যাটেলাইটের যুগের তুলনায় সেকালের পরিকল্পনার প্রয়োগ হতো অনেক বেশি। এখন হয়ত এসবে ডিসেনসিটাইজড হয়ে গেছি, অথবা অন্য কিছু হয়েছে। কিন্তু আগের মতন আর নেই ব্যাপারগুলো এটা বুঝি...

এখনকার সময়ে চারপাশে পরিকল্পনা আর 'রামাদান টিপস, প্ল্যানিং' ইত্যাদি নিয়ে অজস্র লেখা, ফেসবুক পোস্ট, টুইট, ইমেইল পাওয়া যায় অনেক বেশি। মাঝে মাঝে অস্থির লাগে এত কথার আয়োজন আর এত বেশি কথা ও জ্ঞানের ছড়াছড়ি দেখে। বিগত অনেকগুলো বছর খেয়াল করেই হয়ত, এবার কেন জানি আমি পুরো বিষয়গুলোতে নির্বিকার অনুভব করি ইদানিং। এত বেশি অ্যাম্বিশাস, এত বেশি স্কলারলি কথা চলে এখানে-সেখানে, যা খুবই অবাস্তব লাগে আমার কাছে। আমি তাই সচেতনভাবে অধিকাংশ উৎসের কথাবার্তা এড়িয়ে গিয়েছি এই শা'বান মাসে।

আমি প্রথমত চেষ্টা করেছি অনলাইন জগত থেকে অনেক দূরে থাকার। এতে প্রচুর টিপস, প্রচুর ব্যাখ্যা, এন্টি-ব্যাখ্যা, ২০ রাকাত-৮রাকাতের তর্ক থেকে বাঁচা যায়। যেসব মসজিদে এসব ক্যাচাল নিয়ে খুতবা দেয়, সেসব থেকে যে খতীব সাহেবরা জীবনঘনিষ্ট কথা বলেন তাদের কাছাকাছি থেকে তাদের আমল ও আদব অনুধাবন করার চেষ্টা করছি। আমি জানি আমার কত বেশি ভুল, আমল ও ইখলাসের কত অভাব। তাই তর্কের মাঝে ডুব না দিয়ে নিজেকে সময় দেয়াই প্রয়োজন মনে করছি।

বিগত অনেকগুলো বছরে অনলাইনের টিপসের বহর দেখে সবার আগে আমার হতাশ হতাশ লাগতো। মনে হতো সবাই মনে হয় রোজায় ইবাদত করে ফাডাইয়া ফেলতেসে/ফেলবে; কিন্তু আমার লাইফ-স্টাইল যেমন, তাতে আমি তো তেমন খুব একটা আগাতে পারিনা ইবাদাত করায় ও জ্ঞানার্জনে। খুব খেয়াল করে মনে হয়েছে, আসলে এসবের মাঝে শো-অফটাই অনেক বেশি। হয়ত সবাই ইচ্ছা করে করে না, বা হয়ত তারা বুঝেন না, কিংবা হয়ত তারা আসলেই কাজে আন্তরিক তাই প্রকাশ হিসেবে অত কথা বলেন। কিন্তু আসলে, এত কথার খুব কমই পালন হয় বলে আমার মনে হয়। আমি তাই এসব বিষয়গুলোকে হালকা হিসেবে দেখতে চেয়েছি, অগুরুত্বপূর্ণ মনে করতে চেয়েছি। সেই সাথে পূর্বেকার অফলাইন যুগের সময়ের মতন করে, স্থানীয় মসজিদের ইমামদের কথাগুলো শুনতে চেয়েছি, উপলব্ধি করতে চেয়েছি। যাদের মুখের কথাগুলো কাজে পরিস্ফূটন ঘটে, এমন মানুষদের কথাগুলোতে ও উপদেশের মাঝে কল্যাণও বেশি। ক'দিন আগে ইমাম গাজ্জালির 'বিদায়াতুল হিদায়াহ' বইটি পড়তে চেষ্টা করেছিলাম আত্মিক উন্নতির জন্য, হিদায়াতের পথে পা বাড়াতে সূচনায় কী কী খেয়াল রাখা উচিত তা বুঝতে। অনেক কিছু একদম নতুন করে উপলব্ধি করেছি তা সত্যি!

সব মিলিয়ে পরিকল্পনার ব্যাপারে যা অনুভব করছি তা হলো--
দরকার আন্তরিকতা (ইখলাস) বাড়ানো, আল্লাহর স্মরণ বাড়ানো। আর তাই, প্রয়োজন নিজের ভেতরের খারাপগুলোকে দূর করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। কেননা নিজের ভেতরের খারাপগুলোকে দূর না করলে প্রয়োজনীয় আত্মিক উন্নতি হবে না যতই আমরা ভালো বিষয় শিখি বা ভালো কাজ করতে থাকি না কেন। মূল বিষয় হলো খারাপ থেকে সরে আসা; উদাহরণ হিসেবে বলা যায় হিংসা-লোভ-ক্রোধ-গীবত ইত্যাদি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করা।

এক ভাইয়ের কাছে শুনলাম, ইমাম মালিক নাকি রমাদান প্রস্তুতি হিসেবে হাদিস গ্রন্থগুলোও সরিয়ে রাখতেন যেন শুধু কুরআনের সাথে সময় দিতে পারেন। আমরা তো জানিই, রমাদান কুরআন নাযিলের মাস। আমারও তাই মূল উদ্দেশ্য কুরআনের সাথে সম্পর্ক বাড়ানো। পরিকল্পনা বলতে এতটুকুই -- প্রতিদিনের নামায, তারাবীহ এর পাশাপাশি কুরআন তিলাওয়াত এবং কুরআনের অর্থ পড়া, সেগুলোকে গভীর থেকে চিন্তা করা, অনুধাবন ও উপলব্ধি করা। অফিস, ঘর, মানুষজন পেরিয়ে যতটুকুই সময় পাবো, তা থেকে বেশিরভাগটা কুরআনকেই দিবো ইনশাআল্লাহ। চেষ্টা থাকবে যিকির করা, সময় একদম নষ্ট না করা। নিজেকে আগের চেয়ে ভালো মানুষ করার চেষ্টা করা। এটুকুই, স্রেফ এটুকুই আমার পরিকল্পনা।

পৃথিবীতে যতই জ্ঞান উপচে পড়ুক, যত ভালো মানুষই থাকুক --তাতে আমার কিছুই আসবে যাবে না যদি আমার হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি আন্তরিকতা, নিজের মাঝে জ্ঞান না থাকে এবং প্রতিদিনের আচরণে-কাজে ঈমানের সৌন্দর্যের ছাপ না থাকে। তাই নিজের প্রতি খেয়াল করার, রবের সাথে নিজের সম্পর্ক উন্নয়ন করার এবং কুরআনকে চেনার-জানার-বোঝার চেষ্টাই থাকবে এই রামাদানে। ইনশাআল্লাহ আমাদের রব আমাকে ও আমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করবেন না। ইনশাআল্লাহ একটি কল্যাণময় রমাদান হবে ১৪৩৬ হিজরির এই রমাদান। আল্লাহ আমাদের জীবনকে বরকতময় করুন এবং আরো অনেক সফল রমাদান যেন আমাদের দান করেন। আল্লাহ আমাদের হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, উত্তম-সুন্দর-পরিচ্ছন্ন জীবন দান করুন।


* * *
ঢাকা। শা'বান, ১৪৩৬ হিজরি।
১৭ জুন, ২০১৫ ঈসায়ী।