১৪ অক্টো, ২০১৪

চরিত্রবান সন্তান পেতে হলে দরকার ভালো বই


আমার জীবনের খুব বড় একটা সময় আমি সাহিত্যে ডুব দিয়ে থেকেছি। আমার বাল্য আর কৈশোরের পুরোটাই ছিলো বইয়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়া। বাংলা সাহিত্য, বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদগুলো যেখানে পেতাম পড়ে ফেলতাম। আল্লাহ যেটুকু জ্ঞান দিয়েছেন সেটুকুকে পূর্ণ ভালোবাসায় ব্যবহার করা হয়েছিলো বইপাঠে। জীবনে পরবর্তীতে টের পেয়েছি আমার যেকোন পড়াশোনায় পৃষ্ঠা সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি হয় উপলব্ধি ও অনুধাবন। রবীন্দ্র-নজরুল, শরত-বঙ্কিম, সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ, গোর্কি-তলস্তয়-শেক্সপিয়র পেরিয়ে একসময় ঘোর ভাঙ্গে ভার্সিটি লাইফে এসে। বাস্তব জীবন আর পেছনের হাজার হাজার দিনের কল্পনার জগতে বহু বহু পরিস্থিতি পেরিয়ে আসা জীবনের ফারাকটুকুকে বুঝতে ও নিজের অন্তরকে তা বুঝাতে অনেক বেশি সময় চলে গিয়েছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চারপাশে অর্থহীন এক প্রকান্ড স্বাধীনতা, স্বেছাচারিতার সুযোগগুলোকে কেন অপছন্দ হতো, এটা নিজেকে বুঝাতে হয়েছিলো। সেসময় দেশে ও বিশ্বে যেসব মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটতো যেগুলোতে চারপাশের প্রায় সবার নিরুদ্বেগ থাকাটা মেনে নিতেও কষ্ট হতো।

আমি ততদিনে বুঝতে পেরেছিলাম, প্রতিটা মানুষ, হোক সে জ্ঞানী অথবা আকাঠ মূর্খ, প্রত্যেকেই নিজ নিজ ব্যক্তিগত দর্শন গড়ে তোলে সময়ের সাথে সাথে। যে কোনদিন কোন বই পড়েনি, সে তার চারপাশের নিম্নমানের কিছু বিষয়কে 'স্ট্যান্ডার্ড' বানিয়ে নিজ জীবন আচরণ ও ব্যবহার তৈরি করেছে। যার পারিবারিক শিক্ষায় ক্রোধ ও হিংসা ছিলো, সে ভার্সিটিতে প্রচুর মারপিট ও কূটনামি করেছে। খুব অল্প কিছু ছেলে ছিলো যারা পূর্ব জীবনে পাঠ্য বইয়ের বাইরে পড়েছিলো। যারা বই পড়েনা, তাদের সাথে আমি বেশিক্ষণ আলাপ করতে পারতাম না, দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হতো। তাদের চিন্তা ও আলাপের গন্ডি বেশিরভাগ সময়েই কখনো অপর মানুষ, স্যার-ম্যাডাম, নারী-চলচ্চিত্র পেরিয়ে যেতে পারেনি, কখনই না।

একটি উত্তম পাঠক সমাজের প্রয়োজনীয়তা সম্ভবত তখনই তীব্রভাবে অনুভব করা শুরু করেছিলাম। কিন্তু যারাও পড়েছিলো শরত-বিমল মিত্র-সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ থেকে কিছুমিছু, তাদের মাঝেও বিচিত্র জীবনদর্শনের সীমাবদ্ধতা অনুভব করতাম, আচরণের মাঝে ও চরিত্রের মাঝে কলুষতার উপস্থতি ছিলো লক্ষ্যণীয়। আমি নিজেও জানি, সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু-বুদ্ধদেব গুহদের লেখায় ব্যক্তিগত দর্শন ও বিশ্বাসের স্পষ্টতা ছিলো। নারী ও যৌনতার উপস্থিতিগুলো আমার তখনকার গতানুগতিক মুসলিম মনেও অগ্রহণযোগ্য ছিলো। আমি তখন থেকে সুন্দর শিক্ষার জলধি খুঁজতে ব্যস্ত ছিলাম যেখানে ডুব দিয়ে আমি শান্তি পাবো, শিখতে পারবো, নিজেকে শেখাতে পারবো।

ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটির খোঁজ পাওয়া আমার জীবনের একটা রাহমাত ছিলো। উস্তায নুমান আলি খান, ড তারিক রমাদান, ড বিলাল ফিলিপস, ইমাম সুহাইব ওয়েব, ইমাম আনওয়ার আল আওলাকি, শাইখ ইয়াসির ফাজাগা, শাইখ ইয়াসির ক্বাদি, শাইখ হামজা ইউসুফ, ড জাকির নায়েকর অডিও-ভিডিও লেকচারের কাছে আমি আমার ফিলোসফিক্যাল ও ইন্টেলেকচুয়াল প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে দমবন্ধ জীবন থেকে উদ্ধার পেয়েছিলাম। সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে শেখা ও লেখার একটা সময় আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন বেশ ক'টি বছর...

কিন্তু তবু খটকা রয়েই যায়। সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা, মনের জন্য গল্পের প্রয়োজনীয়তা আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করছিলাম অনেকদিন। স্কলারদের আলাপে, একাধিক বইতে আমি এই প্রসঙ্গে পড়েছিলাম বিগত কয়েক বছর। কয়েকজন ব্রাদারের সাথে আলাপও করলাম এই বিষয়ে। এক পর্যায়ে ছেলেবেলায় পড়া নসীম হিজাযীর বইগুলোকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসলাম। নতুন করে আবার পড়তে এসে টের পেলাম বইগুলো কতটা বড় রত্নভান্ডার। ইসলামিক স্পিরিট আর ইতিহাসের এক সমুদ্র যেন সেই বইগুলো!

আমি আমার সকল ছোটভাইদের আন্তরিক অনুরোধ করবো, সকল পড়াশোনার পাশাপাশি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসগুলো পড়ে ফেলতে। আল্লাহ নসীম হিজাযীকে ভুলত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতবাসী করুন। আমার গোটা জীবনের ক্ষুদ্র জ্ঞানের সীমানায় এরকম শক্তিমান সাহিত্যিক আর পাইনি। তার লেখায় ইতিহাস থাকে জীবন্ত, মুসলিম চেতনা ও স্পিরিট থাকে পুরোপুরি। সেইসাথে উপন্যাসের স্বার্থে গড়ে ওঠা চরিত্রগুলো থেকে নেয়ার থাকে ঈমানের দীপ্ততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, প্রশান্তি। আমি টুকটাক লিখতে চেষ্টা করি প্রায় একযুগ হলো। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ কাউকে যথেষ্ট লেখনীশক্তি ও রাহমাত না দিলে এমন উপন্যাস কিছুতেই লেখা সম্ভব নয়।

আমি ইনশাআল্লাহ খুব শীঘ্রই নসীম হিজাযীর সকল বই এক-এক করে কিনে ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় নিয়ে আসবো। আমার পড়া বইগুলোর মাঝে শ্রেষ্ঠ ভালোলাগা ছিলো হেজাজের কাফেলা, কায়সার ও কিসরা। হেজাজের কাফেলা পড়ার সময় আমি কৈশোর পেরিয়ে এসেছিলাম, তবু ভালোলাগায়, ঈমানের তেজোদীপ্ত অনুভূতিতে অনেকবার চোখ ভিজিয়েছি তা মনে পড়ে। আল্লাহ নসীম হিজাযীর প্রতি রাহমাত বর্ষণ করুন।

আল্লাহ যেন আমাদের সমাজে নৈতিক বোধের অনুপ্রেরণাময়, যৌনতার চুলকানিমুক্ত সাহিত্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেন। একটি সুন্দর আগামীর জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের বেড়ে ওঠার জন্য স্বাস্থ্যকর সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনের গল্পগুলো, নবীদের গল্পগুলো মুসলিম সন্তানদের মাঝে একদম প্রথম থেকেই জানা থাকা খুব দরকার। আল্লাহ যেন এক সুন্দর সমাজ আমাদের দান করেন যে সমাজের সন্তানরা আলেম, মুজাহিদ, আবিদ হবে।

১৩ যিলহাজ্ব, ১৪৩৫ হিজরি
০৯ অক্টোবর, ২০১৪ ঈসায়ী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে