১ সেপ, ২০১৪

কাকে ভালোবাসছি, কী ভালো লাগছে এসব আমরা চাইলেই প্রভাবিত করতে পারি

​​একটা চিন্তা আমাকে অনেক তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত সেই ছোটবেলা থেকেই। আমার চারপাশের সবাই যেসব নিয়ে আনন্দিত হতো, যা ভালোবাসত --আমার সেসবে আগ্রহ কমই হতো। একটা ছোট্ট উদাহরণ হলো-- যখন সবাই বিকেল ৪টা বাজতেই বাসার বাইরে গিয়ে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলতে শুরু করতো, তার কয়েক ঘন্টা আগে থেকেই হয়ত কোন একটা উপন্যাস কিংবা অ্যাডভেঞ্চারের গল্পে আমি ডুব দিয়ে আছি। যে বয়সে সবাই আর্সেনাল, চেলসি আর রিয়াল মাদ্রিদের কে কাকে পাস দিলো, কয় গোল করলো সেই হিসেব-নিকেশ করতো, তখন আমার সময় কাটত ক্যাম্পাসের নানান রকম মনোকষ্টে ভুগতে থাকা ছোটভাই, বন্ধুদের সঙ্গ দিয়ে, আলাপ করে তাদের বেদনা হালকা করার চেষ্টা করতে করতে। দিনের বেশিরভাগ সময়ে খেলতে থাকা আর খেলা নিয়ে আলাপ করা ছেলেগুলোর সাথে আমার পছন্দের এক বিশাল ভিন্নতা স্পষ্ট হয়ে দেখতে পেতাম। আমি যেসব কাজ করতাম, সেটা হয়ত বাধ্য হয়ে করতাম যার সবই পছন্দের ছিলো তা নয়, কিন্তু যারা কল অফ ডিউটি, এজ অফ এম্পায়ার, কাউন্টার স্ট্রাইক আর ফিফা নিয়ে থাকতো তার কাজগুলো খুবই অর্থহীন আর সময় নষ্ট লাগতো বলে অপেক্ষাকৃত কম অর্থহীন অন্য কিছুতে ব্যস্ত থেকে সময় কাটাতে চাইতাম...


আমি ঠিক এই জায়গাটা নিয়ে ভাবতাম। আমার পছন্দ ওদের মতন নয় কেন? অথবা, ওদের পছন্দ আমার মতন কেন নয়? প্রচলিত এন্টারটেইনমেন্ট যেমন মুভি দেখা, টিভি দেখা, খেলা দেখা, বেড়াতে সমুদ্রতীর বা পাহাড়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রায় সবগুলো থেকে দূরে থেকে কি আমি খুব বেশি 'বোরিং' হয়ে যাচ্ছি? যখন খুব বেশি 'কিছু ভাল্লাগতেসে না' টাইপের মুডে থাকতাম, তখন ভাবতাম হয়ত নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার কারণে আমার কিছু নেগেটিভ ইফেক্ট হচ্ছে। এরপর হয়ত চেষ্টা করেছি অন্য কোন শহরে গিয়ে দু'একটা দিন কাটিয়ে আসার জন্য অফিস থেকে ছুটি জোগাড় করতে। কিন্তু আমি আমার আব্বার মতন অনেক মানষের কথা জানি, যারা এইসব 'টিপিক্যাল বিনোদন' কল্পনা না করেও দিব্যি মানসিক সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে জীবন পার করে দিয়েছেন। তাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য পেয়েছি--তারা সবাই ৫ ওয়াক্ত সলাত মসজিদে গিয়ে আদায় করেন এবং মসজিদে দীর্ঘ সময় আপনমনে থাকেন...

আজ অনেক বছর পরে আমার কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট লাগে। আমরা মূলত স্বস্তি পাই, আনন্দ বোধ করি, পুলকিত হই, উচ্ছ্বসিত হই যখন আমাদের *পছন্দের* কোন ব্যাপার আমাদের অর্জিত হয়। অন্যদিকে আমরা মূলত আমাদের পছন্দকে তৈরি করি। আর সেই পছন্দকে আমরা পেলে আনন্দিত হই, না পেলে কষ্ট পাই। পছন্দ কেমন করে তৈরি করি তার নজীর অনেক দেখেছি। মাদ্রাসাতে ছোটকালে পড়াশোনা করা একটা পুরোপুরি গ্রামের ছেলেকে দেখতাম লিংকিন পার্ক, মেটালিকা, আয়রন মেইডেন শুনতে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করতো যদিও ওর পূর্ববর্তী গোটা জীবনে ইংরেজি গানের অস্তিত্ব ছিলো না। তার অন্য আচরণে বুঝতাম সে 'ভাব নিতো' আসলে। শুনেছিলাম সে এককালে মসজিদে আযান দিতো। কিন্তু ভার্সিটিতে তার কম্পিউটারে পর্নোগ্রাফির আনাগোনার গল্প তার ক্লাসমেটদের মুখে শোনা যেত। সে হয়ত তার 'ভালোলাগা' তৈরি করেছিলো ঐ 'ইয়ো টাইপ' লুকের ছেলেগুলোর মাঝে তাই তারা যা-ই করতো, সেটাই সে রপ্ত করেছিলো। নিজ পছন্দ অন্য পাপাচারীদের কাজে স্থাপন করে ফেলার পর তার আনন্দ হয়ত দ্বীন পালন থেকে ধীরে ধীরে শো-অফ, অশ্লীলতা, ড্রিংকস, গাঁজায় চলে যায়। একই রকম বিষয় হয় এই দেশের হিন্দি সিরিয়ালখোর আন্টি-আপুদের মাঝে, শো-বিজে মুগ্ধ দরিদ্র প্রাণগুলোর মাঝে। তাইতো 'পাখি' না পেলে জীবন হারাতেও কুণ্ঠিত হয় না তারা...

কাকে ভালোবাসছি, কী ভালো লাগছে --এটাও আমরা চাইলেই প্রভাবিত করতে পারি। আমি দেখেছি, কেবলমাত্র মসজিদে সময়মতন জামা'আতে সলাত আদায় করতে পারার আনন্দে উৎফুল্ল মানুষকে, যার হৃদয় বিপুল আনন্দে উদ্বেল থাকে। টিপিক্যাল মেয়েদের মতন শো-অফ আর হ্যাং আউট না করে পুরোপুরি ভিন্নতার মাঝে থেকেও আমাদের বোনেরা দিব্যি আনন্দপ্রাণে বেঁচে থাকেন। আনন্দ আর ভালোলাগা থাকে না অনেক টাকায়, আরামদায়ক বিছানায়, প্রচুর কেনাকাটায় কিংবা দেশ-বিদেশ ভ্রমণে। এসব স্ট্যান্ডার্ড স্রেফ চারপাশের শেখানো। তাইতো শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা আল্লাহকে ও রাসূলকে ভালোবাসা। এই আদর্শকে পছন্দ করলেই তা আমাদের মাঝে ভালো কাজ তৈরি করতে থাকে। ভালো কাজকে পছন্দ করলেই একটা ভালো কাজ আমাদের যে আনন্দ দিবে তা শত বিনোদনেও সম্ভব নয়। ভালো কাজকে ভালোবাসা তাই আত্মাকে মুক্ত করার, প্রাণকে প্রশান্ত করার একটি বড় কৌশল। ক্ষুদ্র এই জীবনকে কেন আমরা অর্থপূর্ণ করবো না? আল্লাহ যেন আমাদেরকে তার পছন্দকে পছন্দ করে তা পালন করার তাওফিক দান করেন...

[১৪ আগস্ট, ২০১৪]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে