এখনকার সময়ে বিষণ্ণতা নানান কারণে হয়। বংশগতভাবে, মানসিকতার কারণে কিংবা পারিপার্শ্বিক কারণে বিষণ্ণতা গেঁড়ে বসে আমাদের মাঝে। বিষণ্ণতা একদমই নেই এমন মানুষ বেশ বিরল, এমনকি এখনকার অনেক পরিসংখ্যান বলে যে বর্তমান সমাজব্যবস্থায় শিশুরাও বিষণ্ণতায় ভুগে। অর্থাৎ, বিষণ্নতায় ভোগা মোটেই খুব অস্বাভাবিক কিছু নয় এখনকার সময়। তবে, বিষণ্ণতা পুষে রাখা মানসিক,শারীরিক এবং আত্মিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের কি আসলে নিজেদের ক্ষতি করার অধিকার আছে? বিষণ্ণ হয়ে অসুস্থ হতে থাকার সুযোগ কি আছে? বিষণ্ণতায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাওয়া, কর্তব্য পালনে অবহেলা, ত্যক্ত-বিরক্ত থাকা স্বাভাবিক কিছু বিষয়। কিন্তু আল্লাহ কি আমাদেরকে সেই অনুমতি দিয়েছেন?
একটি সুন্দর জীবন হলো আল্লাহর উত্তম বান্দা হওয়া, ইসলামী জীবন ধারণ করা। ইসলাম আমাদেরকে সবসময় নতুন করে জীবন সাজাতে অনুপ্রেরণা দেয়, উৎসাহ দেয় প্রতিদিনের সমস্ত কাজের মাঝে প্রায়োরিটি সেট করা বা অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করা। ইসলাম আমাদেরকে শেখায় আমাদের নিজ নিজ পরিবার ও অন্যান্য সার্কেলগুলোর সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে।
মূল কথা হলো, আমাদের উচিত নিজেদের প্রতি নির্মম না হওয়া বরং নিজেকে অনুগ্রহ করা। এছাড়াও নিজের শরীরকে, বাবা-মাকে, ভাইবোনকে, স্বামী-স্ত্রীকে, সন্তান-সন্ততিকে , আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, মুসাফির ও সাহায্যপ্রার্থীদেরকে তাদের নিজ নিজ প্রাপ্যগুলো দেয়া। এগুলোর মাধ্যমে আমরা নিজেদেরই উন্নতি ঘটাই। তবে, সবকিছুর মূলেই আমাদের ভেতরের আমি। যে আমার শরীরটার মাঝে আমরা নিজেদের বয়ে বেড়াচ্ছি এতগুলো বছর, সেই আমাকে আমরা কতটুকু অনুগ্রহ করেছি/করছি? আমাদের নিজেদেরকে নিজেদেরই বেশি করে ভালোবাসতে হবে। আমাদের নিজেদেরকে আরো দয়া করতে হবে।
আল্লাহ কুরআনে বলেছেন:
"আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা দিয়ে আখেরাতের ঘর তৈরি করার কথা চিন্তা করো এবং দুনিয়া থেকেও নিজের অংশ ভুলে যেয়ো না। অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করো না। আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” [সূরা ক্বাসাস, ২৮: ৭৭]
নিজেদের উপরে আশা হারিয়ে ফেলা ঠিক নয়। বরং, এই পৃথিবীতে আমাদের আসার মূল উদ্দেশ্যটা নিজেদের ভেতরে ভালো করে গেঁথে নেয়া উচিত। কেন এসেছি দুনিয়াতে, কতদিন থাকি এখানে, কী পাই, কেন পাই, কেন সবকিছু হারায়, কেন চলে যেতে হয় একদিন। এগুলোর উত্তর জানলে কোন ঘটনা আমাদের খুব বেশি তাড়িত করবে না। ইসলাম আমাদের এসব প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দেয়।
আল্লাহ আমাদেরকে সবধরণের সম্ভাব্য অশান্তি, অস্থিরতার উত্তর জানিয়ে দিয়েছেন কুরআনে, তিনি আমাদের সমস্ত দোয়া শোনেন, এমনকি বুকের ভেতরে যে চাওয়া, যে আর্তি গুমরে ওঠে নিঃশব্দে-- তিনি সেটাও স্পষ্ট জানেন। আল্লাহ সবসময়েই আমাদের সাথে আছেন। জীবনে আমাদের যা কিছু ঘটে, সবকিছুরই অর্থ রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ পৃথিবীটাকে 'সিস্টেমেটিক' করে বানিয়েছেন।কষ্ট-প্রশান্তি, শক্তি-দুর্বলতা, রোগ-সুস্থতা সবকিছুই আমাদের জীবনেরই অংশ এবং তারা আল্লাহর নির্দেশেই আসে। আল্লাহ খুব ভালো করে জানেন আমাদের অবস্থা। তাই কখনই আশা হারানো উচিত নয় বরং ধৈর্যধারণ করা উচিত। নিশ্চয়ই কষ্টের পরেই স্বস্তি থাকে। ঈমানদারদের জীবনে যতক্ষণ ঈমান আছে বুকের মাঝে, তার সবকিছুই কল্যাণকর। এমনকি কাঁটা ফুটলেও, রোগ হলেও, সম্পদ হারিয়ে গেলেও, প্রিয়জনের শোকের মাঝেও কল্যাণ রয়েছে। আল্লাহ এগুলোর বিনিময়ে পুরষ্কার দেবেন এবং তার পরিমাণও হবে অনেক বড় যা আমাদের কল্পনার অতীত।
কুরআনের কিছু আয়াত আমাদেরকে প্রশান্তি দেয়--
“হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছো তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও করুণাময়।”[আয-যুমারঃ৫৩]
“তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব।” [গাফির - ৬০]
“বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে।”[আল বাকারা:১৮৬]
“যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব....”[আল ইবরাহিম:৭]
সর্বপ্রথম তাই আল্লাহর উপরে ভরসা করতে হবে। নিজেকে চিনতে ও জানতে হবে, নিজের পরিচয় ও জীবনের অর্থ বুঝতে হবে। নিশ্চিত থাকতে হবে গায়েবের মালিকের পরিকল্পনার ব্যাপারে। আমরা খুব কমই জানি এই সৃষ্টিজগতের। আল্লাহ সবকিছু বানিয়েছেন এবং তিনিই সবকিছুর একচ্ছত্র অধিপতি এবং তার সৃষ্টির মাঝে কোন খুঁত নেই। তিনি পরম দয়াময়। আমাদের জন্য তিনি কখনই অকল্যাণকর কিছু করেননা, আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে আমরা অনেককিছুই বুঝিনা। নিশ্চয়ই কষ্টের পরেই স্বস্তি আছে। অবশ্যই কষ্টের পরে স্বস্তি আছে।
[০৬ মে, ২০১৫]