৬ মে, ২০১৫

এত কিছু পড়ি ফেসবুকে আর ওয়েবসাইটগুলোতে প্রতিদিন, উপকার কতটুকু?

​এই যে এত শত-শত শব্দ ফেসবুকের নিউজ-ফিড জুড়ে, এত সহজলভ্য কি বাংলা শব্দেরা আগে কখনো ছিলো? ছিলো না। শুধু বাংলা নয়, পৃথিবীতেই শব্দেরা কখনো এতটা সহজলভ্য, এতটা সস্তা ছিলো না। কত লেখক এখন, কত আবেগ এখন! আবেগ প্রকাশ হয় ইমোটিকন দিয়ে। 'কোলন ডি' চেপে দেয়া মানুষরা বেশিরভাগ সময়েই দাঁত বের করে হাসা দূরে থাক, মুচকিও হাসে না। আবেগের স্ফূরণ কি এতই সহজ?


যেসব আবেগের দোহাই দিয়ে এখন সোশাল নেটওয়ার্কগুলোতে অনেক বড় বড় কথা লেখা হয়, সেগুলোতে আদৌ কি গভীর অনুভূতি থাকে? কেবল নিজ জীবনের ক্ষুদ্র গন্ডির দর্শন, অভিজ্ঞতা থেকে 'জেনারালাইজ' করে কত বড় বড় তাত্ত্বিক লেখাই না আজকাল চোখে পড়ে! পুরুষ কিংবা নারী, ধর্ম কিংবা জাতি, মানবতা আর ন্যায়-অন্যায়কে একাকার করে লিখতে থাকা মানুষগুলোর লেখনীতে ঝাল থাকে, শব্দের ঢং থাকে, 'জাজমেন্টাল ডিসিশান' থাকে। অপরকে ধুলিস্মাৎ করে দিয়ে নিজের বক্তব্যকে জিতিয়ে দেয়ার এক সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা থাকে। কিন্তু হাজার শব্দের লেখার মাঝে থাকে না গভীরতা।

ফেসবুকীয় নবচিন্তকদের লেখায় পুরুষবিদ্বেষ, নারী স্বাধীনতা, ধর্মবিদ্বেষ, সুশীলতা, স্বাধীনতা, মানবাধিকার, অধিকার, স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি সবকিছুকে একাকার করে লেখা হলেও তাতে থাকে না বেশিরভাগ মানুষের জীবন/অনুভূতি/উপলব্ধি/অভিজ্ঞতাগুলোর প্রতিফলন। এগুলো সাহিত্য নয়, ঊনসাহিত্য। হয়ত এদের অপসাহিত্য বলা যেতে পারে। লিখলেই কি তা পাঠযোগ্য কিছু হয়ে গেলো? দিনভর সমালোচনা আর তিক্ততা ছড়ানো যেসব ফেসবুকীয় শব্দ দিয়ে, তার ফলাফলে সৃষ্টিশীল কিছু নেই। মানুষ নোংরামিতে খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়, ঘা চুলকে মজা পাওয়ার মতন বাজে বিষয়ের আলাপ, লাইক ও শেয়ারিং করে অনেক আনন্দ। কিন্তু মানুষ নিজেকে বদলায় শুধুমাত্র আনন্দিত হলে, প্রেষণা পেলে, মুগ্ধ হলে। ভীতি ও সমালোচনাতে মানুষ সাময়িকভাবে কাজ করে।

সাহিত্য জগতে সবারই অবাধ বিচরণের অনুমতি আছে। কিন্তু নান্দনিক আর কালোত্তীর্ণ সাহিত্য অগভীর চিন্তার মানুষরা লিখতে পারেনি, পারেনা লিখতে। পৃথিবীর সকল সময়েই যত বড় বড় সাহিত্য লেখা হয়েছিলো, তা ছিলো গভীর জীবনবোধ থেকে। জীবনের অভিজ্ঞতা আর বছরের পর বছর ধরে দেখতে দেখতে নানান উপলব্ধি দিয়ে লেখকরা লিখতেন। রুশ, জার্মান, ফরাসী, বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি সমস্ত ভাষাতেই রচিত যে ক'টি গ্রন্থ আমরা জানি, সবগুলোর কারণই গভীর জীবনবোধ। কেউ কেউ গোটা জীবনে হাতে গোণা কয়েকটি উপন্যাস লিখেছিলেন। কিন্তু তাতে ছিলো জীবনকে অনেক গভীর থেকে দেখা দর্শনের প্রতিফলন। ভেবে দেখেছি কি আদৌ?

আমাদের চারপাশে এখন অগভীর সাহিত্য, অগভীর সিদ্ধান্ত, অগভীর লেখনী, চিন্তাহীন লাইকিং, দায়িত্ববোধহীন অসৌজন্যমূলক কমেন্টিং --বুদ্ধিবৃত্তিক দূষণ ঘটে এই ফেসবুকেই। সস্তা অনলাইন নিউজপোর্টালে মিথ্যে সংবাদ, ভিত্তিহীন সংবাদ, প্রচার ও প্রসার মিডিয়াতেও। প্রতিটি জিনিসই দূষিত করে তুলছে আমাদের আত্মাগুলোকে, চিন্তাগুলোকে। সমাজে নৈরাজ্য কেবল প্রসারিত হচ্ছে, তীব্র হচ্ছে। এক অদ্ভুত শেকলে বাধা পড়ছে মানুষজন। এখন দরকার বিশুদ্ধতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা, খুব শক্তি দিয়ে পরিবর্তন। দরকার সাহিত্যে গভীরতা, জীবনবোধের দীপ্তি, সুস্থ ও সুন্দর দর্শন। সুস্থ ও সুন্দর চিন্তার একটি সমাজ গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা দরকার এই ক্রমবর্ধমান ধ্বংস রোধ করতে। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা কে বাঁধবে তা জানিনা..

[০৬ মে, ২০১৫]