ফেসবুকের আশেপাশে থাকা আমার প্রায় ৭ বছর হয়ে এলো। এতটুকু বুঝি, এখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, যাদের জীবনে ঠিক বিশেষ কোন মিশন নেই, ভিশন নেই, সময় কাটানোর মতন 'এন্টারটেইনমেন্ট' নেই-- তাদেরকে নষ্ট-ভ্রষ্ট-বিপথগামী করতে ফেসবুকের মতন শক্তিশালী সোশাল মিডিয়া কমই আছে এখন। এমনকি ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের চিন্তার বিষয়কে বদলে দিতে পারে সোশাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং টপিকগুলো। অর্থাৎ, একটানা যে টপিকের আলাপ হোমপেইজে ভাসতে থাকবে, বইপুস্তক-হালাকা-ক্লাস/দারস বিহীন ইন্টেলেকচুয়াল লেভেলের ছেলেমেয়েরা সেদিন শুধু সেইসব টপিক নিয়েই চিন্তা করতে থাকবে। এভাবে নোংরামির বিষেদাগার, সমালোচনা, অতিমাত্রায় ফানে বিষগ্রস্ত হয়ে বদলে যেতে দেখেছি অনেককে। ফেসবুকে সহজে ছেলে/মেয়েদের কাছে পাওয়া যায়, কমিউনিকেট করা যায়, ছবি দেখা যায়-- এসব কারণেও অনেকে ফেসবুকে আগ্রহ করে। কিন্তু চিন্তা করে দেখলেই ভয় পেতে হয় যে এরকম কোন একটি কিশোর/কিশোরী, তরুণ/তরুণী যদি আমাদের নিজ পরিবারের কখনো হয়, তাহলে তার উত্তম বেড়ে ওঠা কেমন হতে পারে?
যেহেতু জীবনধারা আমরা বদলে দিতে পারিনা রাতারাতি, হয়ত মন্দের ভালো হিসেবে এই বিষয়গুলোকে টুইস্ট করে ভিন্ন কিছু করতে পারি, সুন্দর কিছু কাজের/চিন্তার/বিষয়ের উদ্বোধন অন্তত করার চেষ্টা করতে পারি! আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীদের চিন্তাধারায় জাফর ইকবালের ফালতু-প্রলাপমার্কা নিম্নবুদ্ধির লেখাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা এবং শাহবাগীদের পচে-গলে যাওয়া যুক্তিহীন-নীতিহীন প্রোপাগান্ডাগুলো বাম্পার ফলন হবার বিষয়গুলো আমাদেরকে ভয়ংকর ইঙ্গিত দেয়। জানি, ক্ষতি কেউ ঠেকাতে পারবো না। সুস্থভাবে চিন্তা করার, গঠনমূলক সমালোচনা করার, নৈতিক ও ন্যায়ের ভাবনার উপর ভিত্তি করে মতামত দেয়ার বিষয়টি হারিয়ে হিংসা আর ক্রোধান্ধতার একটি অপসংস্কৃতিতে ভেসে যাচ্ছে সুবিধাভোগী ইন্টারনেট ইউজারদের তরুণ প্রজন্ম। যে ধারায় সামাজিক নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে, পারিবারিক সংস্কৃতিতে, বইপুস্তকের ক্ষেত্রে-- সে ধারায় হয়ত আগামীতে বিশাল পর্বতপ্রমাণ ভয়াবহতার নজীর দেখার বিকল্প নেই। কিন্তু এটাও সত্যি, যেকোন ভালো কাজের চেষ্টা, খারাপকে প্রতিহত করা বা খারাপের আধিক্য কমিয়ে দেয়াও একটা ভালো কাজ এবং তা আমাদের উপরে আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব। নিশ্চয়ই সমস্ত জ্ঞানের মালিক আল্লাহ, সমস্ত সফলতার মালিক আল্লাহ। আমাদের প্রকৃত ও চিরকালীন সফলতা নির্ভর করে আমাদের অন্তরের ভেতরের প্রবল ইচ্ছেটুকুর উপরে।
এই দেশের, এই সমাজের চলমান সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নৈরাজ্যের সমাধান আমি জানিনা, সেগুলো নিয়ে স্কলার-থিংকাররা আমাদেরকে আইডিয়া দিবেন ইনশাআল্লাহ। তবে আমাদের তো বসে থাকা চলবে না। নিঃসন্দেহে জ্ঞানের ন্যুনতম সুস্থ জায়গা ফেসবুক নয়, অনলাইনও নয়। প্রচুর প্রতিকূল ও বাজে বিষয়ের কিছু ভালো বিষয় আছে, সেগুলোর উপরে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তবে, একজন মুসলিম যদি তার ব্যক্তিগত ও আত্মিক উন্নয়নের সুযোগ অন্য কোথাও পায়, তাহলে ফেসবুকে যতক্ষণই কাটাবে, হয়ত তার জন্য সেগুলো অকল্যাণকর হবে। এতকিছুর পরেও কিছু বিষয় খেয়াল করা যেতে পারে--
# যেহেতু ফেসবুকের হোমপেইজের বিষয়গুলো একেকজনের চিন্তার টপিক হিসেবে প্রভাব রাখতে থাকে ক্রমাগত, তাই উত্তম বিষয়গুলোর আলাপ 'রিমাইন্ডার' বা স্মরণিকা হিসেবে নিয়মিত আসতে পারে।
# অনলাইনে অনেক বইয়ের অমুক/তমুক ভার্সন থাকলেও সেগুলো ফেসবুক কানেক্টেড মানুষকে খুব একটা পাঠক বানায় না। পাঠক সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস, তাকে পাঠের জগতে পাঠের সাথে সাথে নিষ্কন্টক সময় চিন্তা করতে হয়। ফেসবুকের 'নোটিফিকেশন' চেক করার উদগ্র বাসনা ও অস্থিরতা একজন মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাধারাকেই অসুস্থ করে দেয়, পাঠকরা এক ধাপ উপরের মানুষ, ফেসবুকিং ও 'এক্সটেনসিভ রিডিং' একসাথে হতে পারেনা বলেই আমার জীবনের অভিজ্ঞতাপ্রসূত বিশ্বাস।
# বইকেন্দ্রিক একটা আলাপ-আলোচনার চেষ্টা হতে পারে নোট/ব্লগপোস্টের মাধ্যমে। স্কলারদের/থিঙ্কারদের বই পড়ার পরে বিভিন্ন ছোট কিন্তু গভীর এবং টু-দা-পয়েন্ট চিন্তা যা স্ট্যাটিসটিক্যাল-হিস্টোরিক্যাল-টেক্সচুয়াল বিষয়ের উপরে বেইজ করে হবে এমন লেখা আমাদের লেখা উচিত। যার যার লেভেল থেকেই চেষ্টা করা উচিত। গভীরতা এক দিনে আসে না। লেখার ধারটাও একদিনে আসে না। এগুলো সবই ক্রমাগত চেষ্টার ব্যাপার। ম্যাগনাম-ওপাস লেখার আগে প্রতিটি লেখকই অজস্র অগভীর লেখা জন্ম দিয়েছেন, দেন, দিবেন। তাই চেষ্টা করে গেলে নিজের কল্যাণ হবে, উম্মাহর কল্যাণ হবে ইনশা আল্লাহ।
# ফেসবুককে জ্ঞানের অ্যাপ্রোচের মূল বিষয় হিসেবে চিন্তা করা আমাদেরকে বদলে আরো নিম্নবুদ্ধির মানুষে পরিণত করে দেবে। ফেসবুকে প্রায় প্রতিদিনই কিছু টপিক ট্রেন্ড করে, এগুলো নিয়ে বসে থাকা বা একটু হলেও 'অ্যাটচমেন্ট/থিঙ্কিং' আমাদের স্মৃতিকে অযথা কলুষিত করে। যেখানে নিয়মিত দোয়া করি আমরা "আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফি'আ" সেখানে অনুপকারী বিষয়ে মাথা ডুবিয়ে থাকা কি সাংঘর্ষিক বিষয় নয়?
# জ্ঞানের মূল উৎস বই। কুরআন আমাদের প্রকৃত আনন্দপ্রাপ্তির-চিন্তার খোরাকের-বন্ধুস্বরূপ গ্রন্থ। আমাদের প্রতিদিন যদি কুরআন এবং হাদিসের সাথে একটুও সম্পর্ক না থাকে বরং ফেসবুক বা পত্রিকা ঠিকঠাক পড়া হয়--নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত আসলেই এই জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনে কিছু করছি কিনা।
# বইয়ের বিকল্প নেই। বই পড়া দরকার। আলেমদের শরণাপণ্ণ হওয়া দরকার। বিষয়টা কঠিন যদিও, কিন্তু যারা চায়, অনেক আন্তরিকভাবে চায়---আল্লাহ তাদের অকল্পনীয়ভাবে পথ বের করে দেন। আর সেই সময়ের পূর্ব পর্যন্ত "জামি'আতুল ইউটিউব" (:P) আপনাকে দেবে অনেকগুলো স্কলার এবং তাদের বিজ্ঞ আলোচনার সন্ধান।
# ফেসবুকে এসে স্রেফ দেখতে পারেন কোথায় কী হচ্ছে, দেখুন প্রিয় শাইখেরা কী বলছেন, কী করছেন। এরপর এসব বিষয়ের পানিতে গা ভিজিয়ে ডুব না দিয়ে ফেরত চলে যেতে পারেন, তাতে ইনশাআল্লাহ কল্যাণ হবে। Islamic Online University দিতে পারে উত্তম শিক্ষার সন্ধান।
বসে থাকার সুযোগ নেই আমাদের। আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা করে যেতে হবে নিজেদেরকে, পরিবারকে, সমাজকে আগের চেয়ে উন্নত করার। মুজাহাদের প্রতিদান আল্লাহ অবশ্যই দিবেন ইনশা আল্লাহ। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সরল-সঠিক পথ প্রদর্শন করুন, আমাদেরকে জান্নাতি হিসেবে কবুল করে নিন।
[ক'দিন ধরে অনেক বিষয় নিয়ে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো তাই দীর্ঘ সময়ের চিন্তাগুলো শেয়ার করলাম। ভুলত্রুটি আমার, যদি কারো কল্যাণ হয় এতে তাহলে আমার কষ্টটুকু সার্থক। আল্লাহ যেন আমাদের উত্তম প্রচেষ্টাগুলো কবুল করে নেন]
* * * * * * * * * *
১৬ মুহাররাম, ১৪৩৬ হিজরি।
১০ নভেম্বর, ২০১৪ ঈসায়ী।
Alhamdulillah! 2 ta id chilo. 2tai delete kore dichi! Ekto "unconnected" mone hoy majhe majhe. Onek diner ovves. Dekhi koto din na chaliye pari :)
উত্তরমুছুনআলহামদুলিল্লাহ। অনেক উপকারি পোষ্ট
উত্তরমুছুন