আমার বাসার নীচতলায় পুরো স্পেসটাই ফাঁকা থাকে, বাড়ির মালিক একটি দরবার শরীফের পীরের মুরিদ। আজকে তাদের পাক্ষিক জিকির দিবস। ঘরভর্তি জনাত্রিশেক লোকের 'লা ইলাহা এল্লাল্লাহ' (ইল্লাল্লাহ হওয়া উচিত) চিৎকারে এলাকা প্রকম্পিত হবার অবস্থা। আল্লাহর একত্ববাদকে কেবলমাত্র চিৎকারের মাধ্যমে জনসাধারণের মনে বসিয়ে দেয়ার ভাবনায় এই আয়োজন কিনা তা কে জানে!! বিগত ঘন্টাখানেক ধরেই এই সশব্দ জিকির চলছে। চলবে অন্তত রাত দশটা অবধি... গমগম শব্দে তৈরি হয়েছে এক ভয়াল পরিবেশ, বুকে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। তাদের এই সশব্দ স্মরণশালায় নেই কোন সৌন্দর্য, মাধুর্য, শুনে আত্মায় কোন প্রশান্তি আসে না...
পরিষ্কার মনে আছে, কয়েক সপ্তাহ আগে এমনই একদিন শুক্রবারে, এই জিকির পার্টি চলে যাবার পরে পাশের বিল্ডিং এর ছাদে কোন এক কিশোর/কিশোরীর উপলক্ষে ব্যাণ্ড কনসার্টের আয়োজন হয়েছিল। সেখানে শোনা গিয়েছিলো -- "মীরাবাঈ, হেইলা, দুইলা দরবার নাচায়। ঝাকানাকা ঝাকানাকা দেহ দোলানা" -- জাতীয় আরো কিছু গান। সেই রাতে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক -- সমগ্র এলাকাবাসী দুলছিলো, তাদের কর্ণকুহরে কম্পন উঠেছিল, ইট-কাঠের ঘরবাড়িগুলো থরথরিয়ে কেঁপেছিলো হাই ভলিউমের কাঁপাকাঁপি সাউন্ড সিস্টেমের দুলুনিতে। এমন কনসার্ট হয় হরহামেশাই, প্রয়োজন হয় কেবল একটা উপলক্ষের...
আমাদের দেশের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও এমনই...
যখন সুভানাল্লাহ (সুবহান আল্লাহ উচ্চারণও সঠিক জানেননা বেশিরভাগই) , আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার পড়ে আরাম করে পেটপুরে খেয়ে, দাঁত খিলাল করে, ধর্মপালনের আত্মতুষ্টিতে ভুগে নরম কোমল বিছানাতে গড়াগড়ি দিচ্ছেন আর্থিক ও শারীরিক দিক থেকে সামর্থ্যবান যোগ্য *মুসলিম ধার্মিক* মানুষগুলো -- তখন তাদের সন্তানদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে 'এফএম রেডিও'-তে রাতের প্রথম প্রহরে আয়োজিত 'ভালোবাসার গল্প' বা 'লাভ গুরু'।
রাতে দেরি করে ঘুমাতে যাওয়া, অল্প বয়সে মোবাইল ফোন হাতে পাওয়া, বয়ঃসন্ধিকালের আবেগের একাকীত্বে ভুগা এই প্রজন্মের লক্ষ লক্ষ সন্তান কৃত্রিম রোমান্সের আলাপে মুগ্ধ হয়ে, ডুবে থেকে মানসিক খরায় ডুবে যেতে থাকে। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর নিঃশেষ সিরিয়ালগুলো, বলিউডি মুভিগুলো, বাস্তবতা বিবর্জিত রোমান্টিক নাটকগুলোর সাথে জুড়ে থাকা এফএম প্রজন্মের সন্তানগুলোর চিন্তার প্রায় পুরোভাগে অনিবার্যভাবেই এইসব প্রেম-রোমান্স দখল করে ফেলে। একদিন তারা জড়িয়ে পড়ে নতুন কোন গল্পে, নতুন কোন উচ্ছ্বাসে। মোবাইল ফোন, ফেসবুকে প্রচুর অশান্তির প্রবাহ, অপ্রয়োজনীয় কথা আর অননুমোদিত উষ্ণতার তরঙ্গ -- যার শেষ কেবলই দুঃসহ অশান্তি আর অনন্ত অশ্রুতে...
এখনকার মোবাইলগুলোতে সহজেই এফএম শোনা যায়, নিষ্পাপ বালক-বালিকারাও সহজেই তা টিউন করতে পারে। জীবনে আদর্শিক আর আনন্দময় কাজ না থাকায় আবশ্যিক অবসরে তারা এফএম কানে লাগায়। ক্রমাগত গান, মিউজিক মূল উপজীব্য। গানের সমস্ত কথাই এই প্রেমভালোবাসা কেন্দ্রিক হওয়ায়, গানের ফাঁকে আরজে-দের দৌড় থাকে ভালোবাসাকেন্দ্রিক আলাপ আলোচনাত। প্রেমের ভালোবাসা ছাড়া জীবন চলেনা -- এমন সব চিন্তা প্রোথিত হয়েই গেছে নতুন প্রজন্মের কাছে এইসব আরজে দের তুচ্ছ নীচ বাতুলতায়।এফএমগু রেডিও স্টেশনগুলো দিনভর এমন চেতনাকেই ছড়িয়ে দিচ্ছে । প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদী ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থা তো টিকেই থাকে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যকে ভোগে পরিণত করে দিতে। তাদের চিন্তাচেতনাকে অন্তরীণ করে দিতে চায় বস্তুকেন্দ্রিকতা, শরীরকেন্দ্রিকতার অনন্ত শেকলে।
আমি পারতপক্ষে কখনই এফ-এম শুনিনা। সেদিন ৫ মিনিট কানে এসেছিলো তখনই একটা গান শুনলাম। গানটার লিরিক ছিলো -- "মায়াবী মাতোয়ালি, রে চাঁদরূপওয়ালি, হিজাবের আড়ালে কী ঝলক দেখালি"... এই গানটা শুনে আমার চোখ ভিজে এসেছিল আপনা-আপনিই। আধুনিক মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টে খুব রিসেন্টলি গানটা বানানো হয়েছে। ভয় হয়, না জানি কত হিজাবী বোনকে এই গানের অত্যাচার শুনতে হবে বখাটেদের কাছ থেকে... যেসব মেয়েরা নিজদের শারীরিক সৌন্দর্যকে আড়াল করে, নম্রতা আর ভদ্রতাকে অর্জন করে জীবন ধারণের চেষ্টা করছেন, এই বিধ্বংসী সংস্কৃতি দেখছি তাদেরকেও ছেড়ে কথা কইবে না!
যারা আত্মিক জ্ঞানে দরিদ্র, অজ্ঞ আর নির্বোধ, যারা আল্লাহর দ্বীনের সৌন্দর্য দেখেনি, স্বাদ পায়নি কখনো -- তাদের কথা বাদ দিলাম; আমরা যারা বুঝি, কি আদৌ কোন সংস্কৃতি তৈরি করছি বা করতে পেরেছি আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য? আমরা কি আদৌ আমাদের সৌন্দর্যময়তাকে দিয়ে কোন সংস্কৃতির স্রোত তৈরি করে তাতে আমাদের মুসলিম কিশোর-কিশোরীদের প্রবাহিত করতে পারছি? তারা কী নিয়ে বড় হচ্ছে, তাদের মানসিক যেই প্রয়োজন, অডিও-ভিজুয়াল, ক্রিয়েটিভ সেক্টরে --- তা তো মৌলিক চাহিদা, সঠিকভাবে পূরণ করতে না পারলে অবশ্যই ভুল জায়গা থেকেই তারা নিবে।
এইসব সংস্কৃতিকে যারা সৃষ্টি করছে, যারা তারুণ্যের উন্মাদনাকে ব্যবহার করে নিপুণভাবে ধ্বংস করছে নীতিবোধ আর পারস্পরিক সম্পর্কের সৌন্দর্যকে, ভালোবাসাকে -- তারা তো এর ফল পাবেই। আল্লাহ সবাইকে একটা সময় পর্যন্ত অবকাশ দেন। [১] এরপর, তার হিসাব হবে কঠিন, তার পাকড়াও অত্যন্ত শক্ত। [২]
এফএম রেডিওর মতন সবক্ষেত্রেই চলমান ভ্রষ্ট আর নষ্ট সংস্কৃতির প্রসারে এই দুনিয়াতেই আমাদের পরিবারগুলোতে শান্তি তিরোহিত, সংসারে অশান্তি, চরিত্রহীনতা, বিকৃত চিন্তাধারা বিস্তৃতি -- কোথায় আমাদের সৃষ্টিশীল প্রবাহ? আমরা কবে আমাদের করণীয় কর্তব্য করব? কবে জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, শিল্পে, সাহিত্য, প্রযুক্তিতে, সংস্কৃতিতে আমাদের পদচারণা হবে নষ্টদের দাস হয়ে নয়, বরং মুসলিমদের নিজেদের মতন করে? সময় এসেছে জেগে ওঠার -- সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজাবার, সাধ্যমতন...
ভ্রষ্ট আর নষ্টদের এই আগ্রাসন তো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, যুদ্ধবিমান আর গোলাবারুদের বিধ্বংসী শক্তির তীব্রতার চাইতে কয়েকশতগুণ বেশি শক্তিশালী এই মারণাস্ত্র। বোমা, মেশিনগান, মর্টারে সর্বোচ্চ মারা যাবে একটা প্রজন্ম, একটা এলাকার মানুষদের। এই মারণাস্ত্রে তিলে তিলে ধ্বংস হয় প্রজন্মের পর প্রজন্ম, ভুলে যায় আপন পরিচয়; ধ্বংস হয় পূর্ণ আকারে।
স্বপ্ন কারখানা, ঢাকা নগরী
১৯ অক্টোবর, ২০১২
* * * *
অনুরূপ এই লেখাটি পড়ুনঃ ফেসবুকে তরুণ প্রজন্মের মাঝে নির্লজ্জতার প্রসার
রেফারেন্সঃ
[১] আল কুরআনুল কারীম :: সূরা আন-নাহল : ৬১
[২] আল কুরআনুল কারীম :: সূরা আল বুরুজ : ১২
[ভিডিও] ইমাম সুহাইব ওয়েব - Understanding Islam and Moderation
[ভিডিও] নুমান আলী খান - Take Hold of Your Future
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে