একদেশে এক রাজা ছিল। তার রাজত্বে সুখের অন্ত ছিলো না। রাজ্যের সব লোক সুখে ছিলো। সেই রাজ্যে কেউ মিথ্যা কথা বলতো না। কেউ অভাবে থাকলেও রাজা ও তার মন্ত্রীরা এসে খোঁজ করতো তার খাওয়া দাওয়া চলে কিনা। না হলে রাজকোষ থেকে তাদের সাহায্য করা হতো। মোটকথা, রাজ্যের সবার মুখে কেবলি রাজার গুণগান।
সেই রাজ্য ক্রমাগত বড় হতে থাকলো। রাজার প্রতি অনুগত যোদ্ধাদের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো আর তারা সবাই মিলে ছুটে যেতে লাগলো রাজ্যের দৈর্ঘ্য বড় করার জন্য। রাজাও খুশি তার বাহিনীর উপর। তার চাইতে সে আরো বেশি খুশি ছিলো তার রাজকুমারের প্রতি। অমন রাজকুমার পাওয়া আনন্দেরই ব্যাপার বটে। পিতার সমস্ত সুন্দর গুণাবলী রপ্ত করেছিলো সে। রাজকুমারের বীরত্বের গাঁথা-গল্প রাজ্যের রমনীকূলের কানে মুখে চলতো। অমন শৌর্যবীর্যের অধিকারী যেই রাজকুমার, তাকে পছন্দ হবেই না কেন? কিন্তু রাজকুমারের এসবে ভ্রূক্ষেপ ছিলো না। সে জানতো, তার কাজ সে করে গেলে একদিন কুঁচবরণ রাজকন্যার মতন সুন্দরী অপরূপা ঠিকই তার অন্দর আলোকিত করবে।
রাজকুমারকে নিয়ে রাজার অনেক আশা ছিলো। তার আশা, তার মৃত্যুর পর তার ছেলে হাল ধরবে রাজ্যের। কিন্তু সে তার ছেলের বীরত্বের চাইতে তার ছেলের শিক্ষাদানের গুণাবলীতে আরো বেশি আশাবাদী ছিলো। রাজকুমার কখনই তার সিপাহসালারদের রণকৌশল শেখাতে কার্পণ্য করে না। বরং, রাজকুমার চাইতো তার সেনাবাহিনীর সবাই তার মতই অসাধারণ বীরত্ব অর্জন করুক। সবাই যখন ক্ষুরধার যুদ্ধবাজ হবে, তখনই তো তাদের সফলতা!
কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন রইলো না। রাজ্যের কিছু হিংসুটে দুষ্ট লোক শত্রুদের রাজ্যের দৈত্যদের সাথে আঁতাত করলো। কিছু দৈত্য মানুষের রূপ ধারণ করে রাজ্যে ঘুরে বেড়াতো। তাদের ডেকে এনে সেই লোকগুলা রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করতে লাগলো। শত্রুরাও জানলো রাজকুমার আর তার সিপাহসালারদের কী করে ভুলিয়ে রাখা যায়। তারা যদি কিছুদিন তাদের যুদ্ধকৌশল নিয়ে চর্চা না করে, তাহলে ক্রমেই তাদের দুর্বল করে দেয়া যাবে। রাজকুমার আর তার সৈন্যেরা প্রতিদিন কয়েকবেলা করে তাদের নিশানা চর্চা করতো। দৈত্যরা এই জিনিসটাকে খুব ভয় পেতো।
একদিন রাজা চলে গেলেন। নতুন রাজকুমার হবে রাজা। কিন্তু সবাই শোকগ্রস্ত। কেউই কাজে মনোযোগী না। এমন সময়ে দৈত্যরা তাদের মনিবের আদেশে প্রথমে সৈনিকদের লক্ষ্য করলো। সাহায্যকারী লোকদের সাহায্যে কিছু সুন্দরীদের দিয়ে কানপড়া দিলো তাদের। তারপর, সৈনিক, উজীর-নাজির-সিপাহসালাররাও মদ-শূরায় মত্ত হয়ে চিত্তবিভ্রম হয়ে পড়ে রইলো এক নাচনেওয়ালীর আড্ডায়। সেদিন হঠাৎ রাজ্য আক্রমণ হলো। দৈত্যের দল কাউকে রেহাই দিলো না। সমগ্র রাজ্যে রক্তের বন্যা বয়ে গেলো। শুধু রাজকুমারের মতন কিছু বীর, যারা সজাগ ছিলো সেদিন--তারাই কেবল প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলো।
রাজকুমার গহীন বনে ছুটে চললো। তার পেছন পেছন ছুটছিলো প্রজাদের অনেকেই। খাল-বিল-নদী-পাহাড় পেরিয়ে তারা ছুটছে তো ছুটছেই। অনেক বছর চলে গেলো, অনেক সময় পেরিয়ে গিয়ে তারা থামলো। গায়ে তাদের ছিন্ন বস্ত্র। বেশিরভাগকেই হারিয়েছে তারা পথে। রাজকুমার একা ছুটে চলছিলো। তার মনে অনেক দুঃখ। বন জুড়ে কেবলি ভয়। একটা বুলবুলি পাখি এলো তার কাছে। রাজকুমারের কাছে কিছু সৈন্য জানিয়েছে তারা বেঁচে আছে, তারা একটু সুস্থ হলেই আবার রাজ্যের খোঁজে যাবে।
এরপর শুধু অপেক্ষার পালা। আশ্রয়হীনভাবে, ছিন্ন পোশাকে কেবলি তারা অপেক্ষায় ছিলো। তারপর একদিন এক পাখি উড়ে এলো তাদের হারানো রাজ্য থেকে। তার পায়ে লেখা চিঠি থেকে জানতে পারলো রাজ্যের শত্রু রাজার মৃত্যু হয়েছে। নতুন রাজা অনেক উদার মানুষ। তাদের ডেকে পাঠিয়েছে। আনন্দভরা মন নিয়ে আবার রাজ্যের পথে বেরিয়ে এলো তারা। পথে অনেকেই যোগ দিতে শুরু করলো। নিজেদের রাজ্যে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই তাদের ফেলে দেবে না। তারা সেই রাজ্যে ফিরে গেলে কত আনন্দ হবে, এই ছিলো পথের কষ্ট ভুলে যাবার সবচাইতে বড় সান্তনা।
তারপর সবকিছু ভুলে গিয়ে পথ চলতো রাজকুমার। পথের ক্লান্তি তাকে ছেঁকে ধরতো, বিশালাকার দৈত্যরা পথে আক্রমণ করতো, খাবলে ধরতো গায়ের কাপড়, হত্যা করবে বলে তারা পিছু ছুটতো! কৌশল করে সে পালিয়ে বাঁচতো। রাজকুমার হতাশ হতো না কেননা সে জেনেছিলো একদিন সে তার গন্তব্য পৌঁছবেই। সেদিন তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হবে। নতুন রাজকুমারী ফুলময়ী তাকে জানিয়েছে তার বীরত্বের অনেক গল্প শুনেছে সে। কথাটা ভেবে আনন্দে ভরে যায় রাজকুমারের মন। খালি পায়ে কাঁটাভরা পথে হেঁটে চলেছে তো কী হয়েছে? এই পথের শেষ মঞ্জিল হলো এক সুন্দর বাগান দিয়ে। ফুল-ফল-স্বচ্ছপানির স্রোত... সেই অপেক্ষাতেই আছে সে।
স্বপ্ন নিয়েই হেঁটে চলে সে... সুখের দিন তো বেশি দূরে নয়!
----------
১০ ডিসেম্বর ২০১০, রাত ১১:৪৮
সেই রাজ্য ক্রমাগত বড় হতে থাকলো। রাজার প্রতি অনুগত যোদ্ধাদের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো আর তারা সবাই মিলে ছুটে যেতে লাগলো রাজ্যের দৈর্ঘ্য বড় করার জন্য। রাজাও খুশি তার বাহিনীর উপর। তার চাইতে সে আরো বেশি খুশি ছিলো তার রাজকুমারের প্রতি। অমন রাজকুমার পাওয়া আনন্দেরই ব্যাপার বটে। পিতার সমস্ত সুন্দর গুণাবলী রপ্ত করেছিলো সে। রাজকুমারের বীরত্বের গাঁথা-গল্প রাজ্যের রমনীকূলের কানে মুখে চলতো। অমন শৌর্যবীর্যের অধিকারী যেই রাজকুমার, তাকে পছন্দ হবেই না কেন? কিন্তু রাজকুমারের এসবে ভ্রূক্ষেপ ছিলো না। সে জানতো, তার কাজ সে করে গেলে একদিন কুঁচবরণ রাজকন্যার মতন সুন্দরী অপরূপা ঠিকই তার অন্দর আলোকিত করবে।
রাজকুমারকে নিয়ে রাজার অনেক আশা ছিলো। তার আশা, তার মৃত্যুর পর তার ছেলে হাল ধরবে রাজ্যের। কিন্তু সে তার ছেলের বীরত্বের চাইতে তার ছেলের শিক্ষাদানের গুণাবলীতে আরো বেশি আশাবাদী ছিলো। রাজকুমার কখনই তার সিপাহসালারদের রণকৌশল শেখাতে কার্পণ্য করে না। বরং, রাজকুমার চাইতো তার সেনাবাহিনীর সবাই তার মতই অসাধারণ বীরত্ব অর্জন করুক। সবাই যখন ক্ষুরধার যুদ্ধবাজ হবে, তখনই তো তাদের সফলতা!
কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন রইলো না। রাজ্যের কিছু হিংসুটে দুষ্ট লোক শত্রুদের রাজ্যের দৈত্যদের সাথে আঁতাত করলো। কিছু দৈত্য মানুষের রূপ ধারণ করে রাজ্যে ঘুরে বেড়াতো। তাদের ডেকে এনে সেই লোকগুলা রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করতে লাগলো। শত্রুরাও জানলো রাজকুমার আর তার সিপাহসালারদের কী করে ভুলিয়ে রাখা যায়। তারা যদি কিছুদিন তাদের যুদ্ধকৌশল নিয়ে চর্চা না করে, তাহলে ক্রমেই তাদের দুর্বল করে দেয়া যাবে। রাজকুমার আর তার সৈন্যেরা প্রতিদিন কয়েকবেলা করে তাদের নিশানা চর্চা করতো। দৈত্যরা এই জিনিসটাকে খুব ভয় পেতো।
একদিন রাজা চলে গেলেন। নতুন রাজকুমার হবে রাজা। কিন্তু সবাই শোকগ্রস্ত। কেউই কাজে মনোযোগী না। এমন সময়ে দৈত্যরা তাদের মনিবের আদেশে প্রথমে সৈনিকদের লক্ষ্য করলো। সাহায্যকারী লোকদের সাহায্যে কিছু সুন্দরীদের দিয়ে কানপড়া দিলো তাদের। তারপর, সৈনিক, উজীর-নাজির-সিপাহসালাররাও মদ-শূরায় মত্ত হয়ে চিত্তবিভ্রম হয়ে পড়ে রইলো এক নাচনেওয়ালীর আড্ডায়। সেদিন হঠাৎ রাজ্য আক্রমণ হলো। দৈত্যের দল কাউকে রেহাই দিলো না। সমগ্র রাজ্যে রক্তের বন্যা বয়ে গেলো। শুধু রাজকুমারের মতন কিছু বীর, যারা সজাগ ছিলো সেদিন--তারাই কেবল প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলো।
রাজকুমার গহীন বনে ছুটে চললো। তার পেছন পেছন ছুটছিলো প্রজাদের অনেকেই। খাল-বিল-নদী-পাহাড় পেরিয়ে তারা ছুটছে তো ছুটছেই। অনেক বছর চলে গেলো, অনেক সময় পেরিয়ে গিয়ে তারা থামলো। গায়ে তাদের ছিন্ন বস্ত্র। বেশিরভাগকেই হারিয়েছে তারা পথে। রাজকুমার একা ছুটে চলছিলো। তার মনে অনেক দুঃখ। বন জুড়ে কেবলি ভয়। একটা বুলবুলি পাখি এলো তার কাছে। রাজকুমারের কাছে কিছু সৈন্য জানিয়েছে তারা বেঁচে আছে, তারা একটু সুস্থ হলেই আবার রাজ্যের খোঁজে যাবে।
এরপর শুধু অপেক্ষার পালা। আশ্রয়হীনভাবে, ছিন্ন পোশাকে কেবলি তারা অপেক্ষায় ছিলো। তারপর একদিন এক পাখি উড়ে এলো তাদের হারানো রাজ্য থেকে। তার পায়ে লেখা চিঠি থেকে জানতে পারলো রাজ্যের শত্রু রাজার মৃত্যু হয়েছে। নতুন রাজা অনেক উদার মানুষ। তাদের ডেকে পাঠিয়েছে। আনন্দভরা মন নিয়ে আবার রাজ্যের পথে বেরিয়ে এলো তারা। পথে অনেকেই যোগ দিতে শুরু করলো। নিজেদের রাজ্যে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই তাদের ফেলে দেবে না। তারা সেই রাজ্যে ফিরে গেলে কত আনন্দ হবে, এই ছিলো পথের কষ্ট ভুলে যাবার সবচাইতে বড় সান্তনা।
তারপর সবকিছু ভুলে গিয়ে পথ চলতো রাজকুমার। পথের ক্লান্তি তাকে ছেঁকে ধরতো, বিশালাকার দৈত্যরা পথে আক্রমণ করতো, খাবলে ধরতো গায়ের কাপড়, হত্যা করবে বলে তারা পিছু ছুটতো! কৌশল করে সে পালিয়ে বাঁচতো। রাজকুমার হতাশ হতো না কেননা সে জেনেছিলো একদিন সে তার গন্তব্য পৌঁছবেই। সেদিন তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হবে। নতুন রাজকুমারী ফুলময়ী তাকে জানিয়েছে তার বীরত্বের অনেক গল্প শুনেছে সে। কথাটা ভেবে আনন্দে ভরে যায় রাজকুমারের মন। খালি পায়ে কাঁটাভরা পথে হেঁটে চলেছে তো কী হয়েছে? এই পথের শেষ মঞ্জিল হলো এক সুন্দর বাগান দিয়ে। ফুল-ফল-স্বচ্ছপানির স্রোত... সেই অপেক্ষাতেই আছে সে।
স্বপ্ন নিয়েই হেঁটে চলে সে... সুখের দিন তো বেশি দূরে নয়!
----------
১০ ডিসেম্বর ২০১০, রাত ১১:৪৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে