আমার প্রায়ই মনে হয় আমাদের প্রযুক্তির যুগে আমরা যা হারিয়েছি, হারাচ্ছি তা হচ্ছে পাঠক। আমাদের সমাজে একটা অদ্ভুত প্রজন্ম গড়ে উঠছে যারা শুধুই মোবাইল আর টেলিভিশনের স্ক্রিনে চোখ সেঁটে রাখে, যাদের চিন্তা ও বোধের জগতটা সংকীর্ণ হতে হতে হয়ত আবেগশূণ্য-বিবেকশূণ্য একটা অদ্ভুত প্রাণীতে পরিণত হবে। বিবেক ও বোধহীন আবেগ তো মূলত নফসের দাস, সেই অনুভূতির প্রকাশকে আবেগ বলার চাইতে 'খায়েশ' বলাই বোধহয় অধিক যুক্তিযুক্ত। আমরাও বোধহয় তাদেরকে বইগামী করতে পারিনা, আমরা হয়ত চাইও না। সামগ্রিকভাবে আমাদের এই সমাজ কী অপরিসীম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বোধকরি যে কেউ অনুমান করতে পারবেন। তাদের থাকবে বুকে বুকে ঘৃণা, মানুষকে বুঝে না বুঝে ঘৃণা করা কিন্তু ভালোবাসতে পারে না কাউকে। 'আমি এইটা পছন্দ করি, আমি ঘৃণা করি' -- টাইপের কথা বলতে পারে, অথচ আরেকটা মানুষকে সম্মান আর বিনয় দেখানো পারে না। আরেকটা মানুষকে বুঝতে হলে, তার হয়ে ভাবতে পারাটা একটা নিয়মিত অনুশীলন যেটা বই পাঠ থেকে শেখা যায়। একজন পাঠক প্রতিটি বইতেই অনেকগুলো জীবনকে যাপন করেন। যে কখনো বই পড়েনা, সে একটাই জীবনকে যাপন করে, আর মনের দিক থেকে খুব অসহায় আর দরিদ্র সেই জীবন।
আমি ছোটকালে সর্বভুক টাইপের পাঠক ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, সেই প্রাইমারি স্কুলে থাকতেই পাঠকসত্ত্বা আমার এমনই অবস্থায় গিয়েছিল প্রায় প্রতিদিনই অন্তত একটা বই পড়ে শেষ করতাম। এখনো নিজের জীবনের পেছনে তাকালে যেই কয়েকটা ভালো অনুভূতি নিজের ক্ষয়ে যাওয়া অবস্থায় সাহস দেয় তার একটা হলো, অ্যাডভেঞ্চার-গোয়েন্দা গল্প-থ্রিলার-উপন্যাস-সাহিত্য-কবিতা পড়ে অন্তত চোখ অনেক দিন থেকে দেখতে শিখেছিলাম, অনেকভাবে ভাবতে শিখেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। প্রকৃতির স্পর্শবিহীন এই ঢাকা শহরের মাঝে থেকেও কৈশোর আমার অনেক সুন্দর ছিলো শত-শত বইয়ের সান্নিধ্যে। মেরু থেকে মরু, সমুদ্র তল থেকে শুরু করে রাশিয়া, মেক্সিকো, আমেরিকার নানান জায়গায়, নানান মানুষের জীবনকে আর সমাজকে বই পড়েই অনুভব করা হয়েছিলো। ... একসময় আমার ভেতরের পাঠক যেন মারা গিয়েছিলো। একসময় অনেকগুলো বছর পাঠ্যবই, লেকচার খাতা আর কিছু পিডিএফ ছাড়া কিছু পড়া হয়নি। পরে যখন নিজের অন্তর্জগতের দুর্দশা বুঝতে পারলাম, ততদিনে প্রযুক্তির পৃথিবীর অস্থির জীবনচক্রে আটকা পড়ে গিয়েছি, যুক্ত হয়েছে চাকুরি জীবন। তবু, নানানভাবে একটু একটু করে পাঠকসত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি, করছি।
অনেকবার অনেক প্রশ্ন এসেছে নিজের মাঝে। আমি কে, কেন এই সময়ে এই পৃথিবীতে কখন এলাম তখন এসব সামাজিক অবস্থাটা এমন, এই সমাজ-সংস্কৃতি-ক্ষমতার বলয়গুলো কীভাবে এমন হলো -- এগুলো জানতে, শিখতে কিছু বই খুঁজে বের করে পড়তে চেয়েছি। অনেক... অনেকগুলো বছর পর যখন মনের চিন্তাগুলর ফলস্বরূপ সৃষ্ট প্রশ্নগুলোর সাড়া পাই, অদ্ভুত ভালোলাগা হয়। এরকম বিষয়গুলো থেকেই উপলব্ধি করি, আমাদের পরিবর্তনগুলো আসে আমাদের ভেতরের অদম্য চাওয়া থেকে। পরিবর্তনগুলো হয় খুব ধীরে, একটু একটু করে আমাদের অবস্থান-চিন্তা-চেতনা বদলাতে থাকে। রাতারাতি কিছুই হয় না। বুঝেছি, স্কলাররা আল্লাহর রাহমাত, তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুর আমরা ধারণা পেতে পারি তাদের বইগুলো পড়ে।
যে জানে এবং যে জানে না সে কখনো সমান হতে পারে না। খুবই অস্থির লাগে মাঝে মাঝে। জীবনের বড় একটা সময় পেরিয়ে কিছু বই পড়তে এসে দেখি অনেক কিছুই অনেক আগে শেখা উচিত ছিলো। আরবি পারিনা, এটা শেখারও একটা তাগিদ অনুভব করি। আমি প্রায়ই আমার আপনজনদের হাত ধরে মিনতি করে অনুরোধ করি পড়ার জন্য। বন্ধুদেরকে সম্ভব হলে বই উপহার দিই যেন পড়ে। আমরা যে কত নিপীড়িত, কত বোকা তা প্রতিটি বই পড়ার পরে মনে হয়। না জানার কারণে আমরা কত নিত্যদিনের ভোগান্তিকে সমাধান না করে কষ্ট করে চলেছি, ভুল না শুধরে আরো ভুলে ডুবে যাচ্ছি... প্রতিটি বই থেকেই শেখার অনেক কিছু থাকে। নিজেকে গড়ে তোলার, প্রত্যয়ী করার প্রেরণা পাওয়া যায়। আমরা তো ক্ষয়িষ্ণু, আমাদের প্রতিদিন আয়ু কমে যাচ্ছে। কিছু না শিখলে এই ছোট্ট জীবনটাকে উন্নত করার সময়ও পাবো না। যত কম জানব, ততই কম উত্তম ব্যবহার হবে সময়গুলোর। আর ততই আমাদের অনন্তকালের জীবনের ক্ষতি বাড়বে।
এই বিষয়টা নিয়ে এরকম করে লেখা হয়ত আমার মানায় না। আমি নিজেও জানি আমি একদমই শূণ্য থেকে শেখা শুরু করতে চেয়েছি, কিছুই জানিনা আমি... তাছাড়া, এগুলো লিখে কোন লাভ আছে কিনা তাও জানিনা। তবে শুধু এই কারণেই লেখা যে, আমাদের আসলে না জেনে, না শিখে নিজেদের উন্নত করা সম্ভব নয় -- কথাটা কিছু মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। আল্লাহর বান্দা হিসেবে আমাদের প্রতিদিন নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন করার তথা, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শেখার কথা। তাই, আমাদের যার যার অবস্থা থেকে যেকোনভাবেই প্রতিদিন পড়াশোনার সময় বের করা উচিত। জীবনের কষ্ট-পেরেশানি-ব্যস্ততা প্রতিটি মানুষেরই ছিলো, যুগে যুগে নানান সমাজে। তবু এসবের মধ্য থেকেই আমাদের প্রিয় মানুষেরা তাদের কাজ করে গেছেন। আমাদেরও উচিত শীঘ্র এই পথে এগিয়ে যাওয়া। সম্ভব হলে আজ থেকেই শুরু করা, দেরি নয়। বিলম্ব করতে করতে এমন যেন না হয় যে কবরে গিয়ে আমাদেরকে আফসোস করতে হয়, আল্লাহ মাফ করুন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদের একটা ঈমানে, জ্ঞানে, আমলে উত্তম হবার তাওফিক দিন, তাঁর পছন্দের উম্মাত হিসেবে কবুল করে নিন।
০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ঈসায়ী
আমি ছোটকালে সর্বভুক টাইপের পাঠক ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, সেই প্রাইমারি স্কুলে থাকতেই পাঠকসত্ত্বা আমার এমনই অবস্থায় গিয়েছিল প্রায় প্রতিদিনই অন্তত একটা বই পড়ে শেষ করতাম। এখনো নিজের জীবনের পেছনে তাকালে যেই কয়েকটা ভালো অনুভূতি নিজের ক্ষয়ে যাওয়া অবস্থায় সাহস দেয় তার একটা হলো, অ্যাডভেঞ্চার-গোয়েন্দা গল্প-থ্রিলার-উপন্যাস-সাহিত্য-কবিতা পড়ে অন্তত চোখ অনেক দিন থেকে দেখতে শিখেছিলাম, অনেকভাবে ভাবতে শিখেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। প্রকৃতির স্পর্শবিহীন এই ঢাকা শহরের মাঝে থেকেও কৈশোর আমার অনেক সুন্দর ছিলো শত-শত বইয়ের সান্নিধ্যে। মেরু থেকে মরু, সমুদ্র তল থেকে শুরু করে রাশিয়া, মেক্সিকো, আমেরিকার নানান জায়গায়, নানান মানুষের জীবনকে আর সমাজকে বই পড়েই অনুভব করা হয়েছিলো। ... একসময় আমার ভেতরের পাঠক যেন মারা গিয়েছিলো। একসময় অনেকগুলো বছর পাঠ্যবই, লেকচার খাতা আর কিছু পিডিএফ ছাড়া কিছু পড়া হয়নি। পরে যখন নিজের অন্তর্জগতের দুর্দশা বুঝতে পারলাম, ততদিনে প্রযুক্তির পৃথিবীর অস্থির জীবনচক্রে আটকা পড়ে গিয়েছি, যুক্ত হয়েছে চাকুরি জীবন। তবু, নানানভাবে একটু একটু করে পাঠকসত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি, করছি।
অনেকবার অনেক প্রশ্ন এসেছে নিজের মাঝে। আমি কে, কেন এই সময়ে এই পৃথিবীতে কখন এলাম তখন এসব সামাজিক অবস্থাটা এমন, এই সমাজ-সংস্কৃতি-ক্ষমতার বলয়গুলো কীভাবে এমন হলো -- এগুলো জানতে, শিখতে কিছু বই খুঁজে বের করে পড়তে চেয়েছি। অনেক... অনেকগুলো বছর পর যখন মনের চিন্তাগুলর ফলস্বরূপ সৃষ্ট প্রশ্নগুলোর সাড়া পাই, অদ্ভুত ভালোলাগা হয়। এরকম বিষয়গুলো থেকেই উপলব্ধি করি, আমাদের পরিবর্তনগুলো আসে আমাদের ভেতরের অদম্য চাওয়া থেকে। পরিবর্তনগুলো হয় খুব ধীরে, একটু একটু করে আমাদের অবস্থান-চিন্তা-চেতনা বদলাতে থাকে। রাতারাতি কিছুই হয় না। বুঝেছি, স্কলাররা আল্লাহর রাহমাত, তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুর আমরা ধারণা পেতে পারি তাদের বইগুলো পড়ে।
যে জানে এবং যে জানে না সে কখনো সমান হতে পারে না। খুবই অস্থির লাগে মাঝে মাঝে। জীবনের বড় একটা সময় পেরিয়ে কিছু বই পড়তে এসে দেখি অনেক কিছুই অনেক আগে শেখা উচিত ছিলো। আরবি পারিনা, এটা শেখারও একটা তাগিদ অনুভব করি। আমি প্রায়ই আমার আপনজনদের হাত ধরে মিনতি করে অনুরোধ করি পড়ার জন্য। বন্ধুদেরকে সম্ভব হলে বই উপহার দিই যেন পড়ে। আমরা যে কত নিপীড়িত, কত বোকা তা প্রতিটি বই পড়ার পরে মনে হয়। না জানার কারণে আমরা কত নিত্যদিনের ভোগান্তিকে সমাধান না করে কষ্ট করে চলেছি, ভুল না শুধরে আরো ভুলে ডুবে যাচ্ছি... প্রতিটি বই থেকেই শেখার অনেক কিছু থাকে। নিজেকে গড়ে তোলার, প্রত্যয়ী করার প্রেরণা পাওয়া যায়। আমরা তো ক্ষয়িষ্ণু, আমাদের প্রতিদিন আয়ু কমে যাচ্ছে। কিছু না শিখলে এই ছোট্ট জীবনটাকে উন্নত করার সময়ও পাবো না। যত কম জানব, ততই কম উত্তম ব্যবহার হবে সময়গুলোর। আর ততই আমাদের অনন্তকালের জীবনের ক্ষতি বাড়বে।
এই বিষয়টা নিয়ে এরকম করে লেখা হয়ত আমার মানায় না। আমি নিজেও জানি আমি একদমই শূণ্য থেকে শেখা শুরু করতে চেয়েছি, কিছুই জানিনা আমি... তাছাড়া, এগুলো লিখে কোন লাভ আছে কিনা তাও জানিনা। তবে শুধু এই কারণেই লেখা যে, আমাদের আসলে না জেনে, না শিখে নিজেদের উন্নত করা সম্ভব নয় -- কথাটা কিছু মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। আল্লাহর বান্দা হিসেবে আমাদের প্রতিদিন নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন করার তথা, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শেখার কথা। তাই, আমাদের যার যার অবস্থা থেকে যেকোনভাবেই প্রতিদিন পড়াশোনার সময় বের করা উচিত। জীবনের কষ্ট-পেরেশানি-ব্যস্ততা প্রতিটি মানুষেরই ছিলো, যুগে যুগে নানান সমাজে। তবু এসবের মধ্য থেকেই আমাদের প্রিয় মানুষেরা তাদের কাজ করে গেছেন। আমাদেরও উচিত শীঘ্র এই পথে এগিয়ে যাওয়া। সম্ভব হলে আজ থেকেই শুরু করা, দেরি নয়। বিলম্ব করতে করতে এমন যেন না হয় যে কবরে গিয়ে আমাদেরকে আফসোস করতে হয়, আল্লাহ মাফ করুন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদের একটা ঈমানে, জ্ঞানে, আমলে উত্তম হবার তাওফিক দিন, তাঁর পছন্দের উম্মাত হিসেবে কবুল করে নিন।
০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ঈসায়ী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে