সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আশায় দাঁড়িয়ে ছিলাম ধানমন্ডির এক বাস কাউন্টারের সামনে। পূর্ববর্তী বাস স্টপেজ থেকে বাসগুলো পুরাই ভর্তি হয়ে আসছিলো। অফিসফেরত, কলেজ ফেরত, মার্কেটফেরত লোকজনের ভীড়ে কোন একটা দরজাতে যে জায়গা করে নিবো-- সেই সুযোগও হচ্ছিলো না।
তবু ভাবলাম, তারুণ্যের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কোনরকম একটা চিপাচাপায় জায়গা করে নিতেই হবে। ফাঁকা রাস্তায় যেই দুরত্বে লাগে মাত্র ১৫ মিনিট, যখন ব্যস্ত দিনে বাসে চড়ি তখন সেটুকুতেই লেগে যায় দেড় থেকে দু'ঘন্টা (ব্যস্ত ঢাকাবাসীর ভীড়ের মর্জিমতন)। আর সেই বাসটাতে উঠবার সৌভাগ্য অর্জন করতে আবার প্রায় আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নিত্য। কিন্তু সেদিন যেন আর তর সইছিলো না...
পরের বাসে সুযোগ করে কোনমতে দরজার সামনেই জায়গা করে নিলাম, অন্ততঃ পথের ধোঁয়া মিশ্রিত বাতাসটা হলেও যেন গ্রহণ করা যায়। নতুবা বাসের ভিতরের দমবন্ধ হয়ে আসা বাতাসে ঘর্মক্লান্ত বাংলার মানুষদের আধা ইঞ্চি দুরত্বে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাটা খুব বিরক্তিকর, অসহায়ত্ব... অসহায়ত্ব বললাম এই জন্য যে, যখন হঠাৎ বাসটা ব্রেক কষে, তখনই আরেকজনের গায়ের উপরে বেঁকে যেতে হয়, আর তখন সেই মানুষটা কিঞ্চিৎ বোধস্বল্প হলেই ঝাড়ি অবধারিত... তখন এরকম একটা অনাকাংখিত ঘটনা নিয়ে ক্লান্ত দেহ আর তিক্ত মনে কী করবো ভেবে খুবই মন খারাপ হয়। তাই, একটু বেশিই সাবধান থাকি...
তবু একটুও স্বস্তি হয়না, নতুন স্টপেজে আরো কিছু মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি... আমি যেমন যেভাবেই হোক ওঠার জন্য ত্রস্তব্যস্ত ছিলাম-- এই মানুষগুলোর চোখেও একই দৃশ্য দেখে বড্ড মায়া হয়। কোনরকমে এক পা ঝুলে যেতে চাওয়া ছেলেটাকে জায়গা করে দিলাম সেদিন। আমারই বয়েসি ছেলে। কিন্তু নিজের জায়গাটা হয়ে যাবার পর সে কিছুতেই আর মানুষকে উঠতে দেবে না!! অথচ পরের স্টপেজে দু'জন মানুষ নেমে যাওয়ায় খালি হওয়া জায়গাতে অন্তত একজন গায়ে গা লাগিয়ে হলেও যেতে পারে... অফিসফেরত ক্লান্ত মানুষগুলো কতনা অসহায় হয়ে বাড়ি ফিরতে চায়!! একটু তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিলেই আমাদের ঢাকাবাসীদের প্রতি করুণা জেগে উঠবে অন্য যে কোন মানবমনের...
সেই তরুণ ওই দরজার সামনে ঝুলে থেকেই দেশের মানুষকে, রাজনীতিবিদদেরকে গালাগালি শুরু করলো। তার কথার তুবড়িতে সারাদিনের ক্লান্তিকে আরো বেশি নির্মম লাগতে থাকে। পারতপক্ষে অযথা স্থানে এলোমেলো কথা না বলার চেষ্টা করি আমি। তবু তখন ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে তাকে প্রশ্ন করে বসলাম-- "ভাই, আপনার পক্ষ থেকে সলিউশান বলেন দেখি এই অবস্থার!" সে কিছুই বলতে পারলো না-- যুক্তিহীন কিছু অপলাপ করলো মিনিটখানেক।
এরপর সুন্দরভাবে তাকে যা বললাম গরম মেজাজে তা আমার কাছে ভালোই লেগেছিলো। কথাগুলো এমন ছিলোঃ
-- আমাদের দেশের সরকার মানে আমাদেরই প্রতিচ্ছবি। আমরা যেমন তেমনটাই হচ্ছে, স্রেফ পরিষ্কার ব্যাপার!!
-- একটা ফ্লাইওভার যদি প্রতিদিনের এই যানযটে কোন সুরাহার একটা পদক্ষেপ হয়-- সেইটা বানাতে আপনি রাস্তা খুঁড়বেন-- তখন রাস্তা আরো চিপা হবে-- আরো বেশি জ্যাম হবে...
-- প্রতিদিন অন্তত হাজার মানুষ এই তিলোত্তমা নগরীতে ঢুকে। কেউ বের হয় কিনা জানিনা।
-- রাস্তায় বাসগুলোতে যারা উঠেন, সেই মহিলাদের কোলে-কাঁখে পিচ্চি-পুসকা থাকে, হাত ধরে থাকে আরেকটা...
প্রতিদিন যেই মানুষগুলো ঢাকায় ঢুকছেন-- তারা বাইরে কেন জীবিকার সন্ধান পাচ্ছেন না? সরকার যিনিই আসছেন ক্ষমতার গদিতে-- অদ্ভূত কিছু ইস্যু নিয়ে, আবেগময় কথন দিয়ে আমাদের "ভ্যাকুয়াম হেড" কে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন বছরের পর বছর... নৈতিক আর ব্যক্তিগত চরিত্রে অতিশয় দীন, হীন রিক্ত নেতা আর রাজনীতিবিদ, সুবিধাভোগী মানুষগুলোর ব্যঙ্ক একাউন্টগুলো অর্থে সিক্ত...
আর আমরা সেই আমজনতা... প্রতিদিন রোদে পুড়ি... ঘামে ভিজি... বৃষ্টিতে সিক্ত হই... প্রায় সমস্ত জাতীয় সুযোগকে করুণার মতন করে পেয়ে চলি... তারপর, পরিষ্কারভাবে দ্বি-বিভক্ত দেশের রাজনীতির কোন এক অংশের অন্ধ আনুগত্যকে আপন করে বিলিয়ে দেই নিজেকে...
হায়! জাতীয় জীবনের অর্থই তো বোধ করি আমরা জানবো না কোনদিন... পৃথিবীটা অনেক সুন্দর আর সহজ হতে পারতো! মাঝে মাঝে নিজের প্রতি, নিজেদের প্রতি বড্ড করুণা হয় আমার!
* * *
১৮ অক্টোবর ২০১০, রাত ০৮:১৫
তবু ভাবলাম, তারুণ্যের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কোনরকম একটা চিপাচাপায় জায়গা করে নিতেই হবে। ফাঁকা রাস্তায় যেই দুরত্বে লাগে মাত্র ১৫ মিনিট, যখন ব্যস্ত দিনে বাসে চড়ি তখন সেটুকুতেই লেগে যায় দেড় থেকে দু'ঘন্টা (ব্যস্ত ঢাকাবাসীর ভীড়ের মর্জিমতন)। আর সেই বাসটাতে উঠবার সৌভাগ্য অর্জন করতে আবার প্রায় আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নিত্য। কিন্তু সেদিন যেন আর তর সইছিলো না...
পরের বাসে সুযোগ করে কোনমতে দরজার সামনেই জায়গা করে নিলাম, অন্ততঃ পথের ধোঁয়া মিশ্রিত বাতাসটা হলেও যেন গ্রহণ করা যায়। নতুবা বাসের ভিতরের দমবন্ধ হয়ে আসা বাতাসে ঘর্মক্লান্ত বাংলার মানুষদের আধা ইঞ্চি দুরত্বে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাটা খুব বিরক্তিকর, অসহায়ত্ব... অসহায়ত্ব বললাম এই জন্য যে, যখন হঠাৎ বাসটা ব্রেক কষে, তখনই আরেকজনের গায়ের উপরে বেঁকে যেতে হয়, আর তখন সেই মানুষটা কিঞ্চিৎ বোধস্বল্প হলেই ঝাড়ি অবধারিত... তখন এরকম একটা অনাকাংখিত ঘটনা নিয়ে ক্লান্ত দেহ আর তিক্ত মনে কী করবো ভেবে খুবই মন খারাপ হয়। তাই, একটু বেশিই সাবধান থাকি...
তবু একটুও স্বস্তি হয়না, নতুন স্টপেজে আরো কিছু মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি... আমি যেমন যেভাবেই হোক ওঠার জন্য ত্রস্তব্যস্ত ছিলাম-- এই মানুষগুলোর চোখেও একই দৃশ্য দেখে বড্ড মায়া হয়। কোনরকমে এক পা ঝুলে যেতে চাওয়া ছেলেটাকে জায়গা করে দিলাম সেদিন। আমারই বয়েসি ছেলে। কিন্তু নিজের জায়গাটা হয়ে যাবার পর সে কিছুতেই আর মানুষকে উঠতে দেবে না!! অথচ পরের স্টপেজে দু'জন মানুষ নেমে যাওয়ায় খালি হওয়া জায়গাতে অন্তত একজন গায়ে গা লাগিয়ে হলেও যেতে পারে... অফিসফেরত ক্লান্ত মানুষগুলো কতনা অসহায় হয়ে বাড়ি ফিরতে চায়!! একটু তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিলেই আমাদের ঢাকাবাসীদের প্রতি করুণা জেগে উঠবে অন্য যে কোন মানবমনের...
সেই তরুণ ওই দরজার সামনে ঝুলে থেকেই দেশের মানুষকে, রাজনীতিবিদদেরকে গালাগালি শুরু করলো। তার কথার তুবড়িতে সারাদিনের ক্লান্তিকে আরো বেশি নির্মম লাগতে থাকে। পারতপক্ষে অযথা স্থানে এলোমেলো কথা না বলার চেষ্টা করি আমি। তবু তখন ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে তাকে প্রশ্ন করে বসলাম-- "ভাই, আপনার পক্ষ থেকে সলিউশান বলেন দেখি এই অবস্থার!" সে কিছুই বলতে পারলো না-- যুক্তিহীন কিছু অপলাপ করলো মিনিটখানেক।
এরপর সুন্দরভাবে তাকে যা বললাম গরম মেজাজে তা আমার কাছে ভালোই লেগেছিলো। কথাগুলো এমন ছিলোঃ
-- আমাদের দেশের সরকার মানে আমাদেরই প্রতিচ্ছবি। আমরা যেমন তেমনটাই হচ্ছে, স্রেফ পরিষ্কার ব্যাপার!!
-- একটা ফ্লাইওভার যদি প্রতিদিনের এই যানযটে কোন সুরাহার একটা পদক্ষেপ হয়-- সেইটা বানাতে আপনি রাস্তা খুঁড়বেন-- তখন রাস্তা আরো চিপা হবে-- আরো বেশি জ্যাম হবে...
-- প্রতিদিন অন্তত হাজার মানুষ এই তিলোত্তমা নগরীতে ঢুকে। কেউ বের হয় কিনা জানিনা।
-- রাস্তায় বাসগুলোতে যারা উঠেন, সেই মহিলাদের কোলে-কাঁখে পিচ্চি-পুসকা থাকে, হাত ধরে থাকে আরেকটা...
প্রতিদিন যেই মানুষগুলো ঢাকায় ঢুকছেন-- তারা বাইরে কেন জীবিকার সন্ধান পাচ্ছেন না? সরকার যিনিই আসছেন ক্ষমতার গদিতে-- অদ্ভূত কিছু ইস্যু নিয়ে, আবেগময় কথন দিয়ে আমাদের "ভ্যাকুয়াম হেড" কে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন বছরের পর বছর... নৈতিক আর ব্যক্তিগত চরিত্রে অতিশয় দীন, হীন রিক্ত নেতা আর রাজনীতিবিদ, সুবিধাভোগী মানুষগুলোর ব্যঙ্ক একাউন্টগুলো অর্থে সিক্ত...
আর আমরা সেই আমজনতা... প্রতিদিন রোদে পুড়ি... ঘামে ভিজি... বৃষ্টিতে সিক্ত হই... প্রায় সমস্ত জাতীয় সুযোগকে করুণার মতন করে পেয়ে চলি... তারপর, পরিষ্কারভাবে দ্বি-বিভক্ত দেশের রাজনীতির কোন এক অংশের অন্ধ আনুগত্যকে আপন করে বিলিয়ে দেই নিজেকে...
হায়! জাতীয় জীবনের অর্থই তো বোধ করি আমরা জানবো না কোনদিন... পৃথিবীটা অনেক সুন্দর আর সহজ হতে পারতো! মাঝে মাঝে নিজের প্রতি, নিজেদের প্রতি বড্ড করুণা হয় আমার!
* * *
১৮ অক্টোবর ২০১০, রাত ০৮:১৫