ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালী এমন একজন মানুষ যিনি প্রায় হাজার বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু তার লেখায় তিনি এমন সব বিষয় নিয়ে লিখেছেন, এমন জ্ঞান শিখিয়েছেন যা প্রকৃতপক্ষে আমাদের মুসলিম সভ্যতার ও মুসলিম মানসের জন্য খুবই দরকারি। তিনি যে শুধুই মুসলিমদের একজন বড় আলেম তা নয়, বরং গোটা বিশ্বের সমস্ত ধর্মের, অজস্র ভাষাভাষী মানুষদের কাছে পৌঁছেছেন তার লেখনীর মাধ্যমে। এটা তার জ্ঞানের, তার লেখনীর গভীরতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তিনি জীবনকে দেখেছিলেন সাধারণদের চেয়ে ভিন্ন চোখে। দ্বীনের ইলমের সাথে তার সুগভীর জীবনবোধ তার লেখনীগুলোকে করেছে ভিন্নমাত্রার। বস্তুত তিনি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যা দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন এবং কাজে করেছেন --সে বিষয়গুলোকেই তার লেখার মাঝে এনেছেন। তিনি এমন সাহিত্য লিখে ছেড়ে দেননি যার সাথে তার কর্মের ও চিন্তার সম্পৃক্ততা ছিলো না; তার জীবনী থেকে এমন বিষয়গুলো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই শক্তিশালী বৈশিষ্ট্যটিই হয়ত তার মৃত্যুর হাজার বছর পরেও তার লেখনীকে সবসময় 'সমসাময়িক' করে রেখেছে, মুসলিম মনে ও মানসে আবেদন জারী রেখেছে।
ইমাম গাজ্জালীর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি বলা হয় 'ইহইয়া উলুমিদ্দীন' বইটিকে। জীবনের শেষ প্রান্তে একটি দীর্ঘসময় নিয়ে তিনি এই বইটি রচনা করেছিলেন। এছাড়াও, 'কিমিয়ায়ে সা'আদাত' নামে কয়েক খন্ডের একটি বই বাজারে পাওয়া যায়। শাইখ হামজা ইউসুফ তার একটি লেকচারে এই বইটিকে ইহইয়া উলুমিদ্দীনের পার্সিয়ান কমেন্টারি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
কয়েক বছর আগেই 'বিদায়াতুল হিদায়াহ' বইটির কথা জেনেছিলাম আমি। এই বইটির উপরে একটি লেকচার সিরিজ শুনেছিলাম যা এই লেখায় উল্লেখ করেছি: http://idream4life.blogspot.com/2012/11/blog-post_13.html
ক'দিন আগে বইটির বাংলা অনুবাদের খোঁজ পেলাম রকমারি ডট কমে : http://www.rokomari.com/book/45566 অর্ডার করে দু'দিনের মাঝে বইটি হাতে পেলাম। উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় ছিলাম, অবশেষে পড়লাম, পড়ছি, আগামীতেও হয়ত আরো পড়বো। বইটি অনুবাদ করেছেন মুফতি মুহাম্মদ উবায়দুল্লাহ। বইটির প্রারম্ভিকা লিখেছেন মাওলানা মুহিউদ্দিন খান। সুপাঠ্য সুন্দর বই। খুবই অল্প দামে একটি রত্নভান্ডার।
'বিদায়াতুল হিদায়াহ'-এর ইংরেজি অনুবাদ করা হয়েছে, 'Beginning Of the Guidance' এবং বাংলাতে অর্থ করা হয়েছে --'হিদায়াতের সূচনা'। আমি যা বুঝেছি তা হলো, হিদায়াতের পথে চলতে শুরুতেই যেসব বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন, সেগুলোর একটি বাস্তবধর্মী ও নির্দেশিকামূলক বই এটি। মূল্য মাত্র ৪৫ টাকা। এই বইতে 'ইহইয়া উলুমিদ্দীনে' উল্লেখিত বিষয়গুলোর সার-সংক্ষেপ আছে। যাদের স্বল্প সময়ে ও স্বল্পপাঠে আত্মার উন্নতি নিয়ে শেখা প্রয়োজন মনে করেন, তাদের এই বইটি উপকৃত করবে ইনশাআল্লাহ।
বই থেকে নেয়া কিছু চুম্বক অংশ:
“আজকালকার যুগের তথাকথিত পন্ডিতদের দেখা যায় যে, বাদানুবাদ ও যুক্তিতর্ক তাদের স্বভাবকে খুবই প্রভাবিত করে রেখেছে এবং নিশ্চুপ থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। কেননা, পান্ডিত্যের দাবীদার অসৎ বিদ্বানেরা তাদেরকে বুঝিয়েছে যে, এই বিতর্ক একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ এবং এর দ্বারা মানুষের নিকট মর্যাদা পাওয়া যায়। খবরদার! এমন লোকদের থেকে তুমি ছুটে পালাও যেমন সিংহ দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তুমি পালাবে। জেনে রাখো, বাদানুবাদ যেমন মানুষের মনে ঘৃণার উদ্রেক করে, তেমনি এটি আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও রোষেরও কারণ হয় বটে!” [বিদায়াতুল হিদায়াহ : ইমাম আল-গাজ্জালী , প্রকাশক: দারুল কিতাব, পৃ-৮৩]
“ইলম ও জ্ঞানচর্চার দ্বারা যদি তোমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আত্মগৌরব ও বড়াই-অহংকার করা, সমকালীন লোকদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করা, আপন প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্ববাসীর নিকট প্রিয়পাত্র অথবা ভক্তিভাজন হওয়া, পার্থিব গৌরব অর্জন করা এবং রকমারী ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করা, তাহলে জেনে রাখো– এই জ্ঞান অর্জনের দ্বারা তুমি তোমার দ্বীন ও ঈমান ধ্বংস করছ, স্বীয় মূল্যবান জীবন বিনষ্ট করছ। নশ্বর এই পৃথিবীর বিনিময়ে আখিরাতের অনন্ত জীবনকে বিক্রয় করে দিচ্ছ। নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত গর্হিত ও ক্ষতিকর কাজ। এই ব্যবসায় তোমার বৃহৎ লোকসান ছাড়া লাভের কিছু অবশিষ্ট থাকছে না।” [বিদায়াতুল হিদায়াহ : ইমাম আল-গাজ্জালী , প্রকাশক: দারুল কিতাব, পৃ-১১]
“জেনে রাখো — যে কোন ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর কোন মাখলুকের তুলনায় উত্তম মনে করবে, সে-ই দাম্ভিক; অহংকারী। বস্তুতঃ তোমার এ কথা মনে রাখা উচিত, যে ব্যক্তি আখিরাতের জীবনে আল্লাহর কাছে ভালো, সে-ই প্রকৃত ভালো। আর এটা এমন এক বিষয়, যা অদৃশ্য এবং জীবনের শেষ মূহুর্তের উপর নির্ভরশীল। অতএব, তোমার নিজেকে অন্যের তুলনায় উত্তম মনে করা নিতান্ত মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়।” [বিদায়াতুল হিদায়াহ : ইমাম আল-গাজ্জালী , প্রকাশক: দারুল কিতাব, পৃ-৯৫]
“দ্বীনি ইলমই হচ্ছে একমাত্র বিদ্যা যা তোমার অন্তরে খোদাভীতি সৃষ্টি করবে, নিজের দোষ-ত্রুটি উপলব্ধি করার জ্ঞান বাড়াবে, সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার পরিচয় করিয়ে দিবে। দুনিয়ার মোহান্ধতা হ্রাস করে আখিরাতের প্রতি শওক ও আগ্রহ বৃদ্ধি করবে, পাপকার্যের কুফল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করবে। ফলে, পাপাচার থেকে বেঁচে থাকার মন-মানসিকতা গড়ে উঠবে, শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক করবে।” [বিদায়াতুল হিদায়াহ : ইমাম আল-গাজ্জালী , প্রকাশক: দারুল কিতাব, পৃ-৪৬]
“দুনিয়াতে সবচেয়ে বোকা ও নির্বোধ সে, যে নিজের পবিত্রতা দাবী করে এবং নিজেই নিজের প্রশংসা করে।”
[বিদায়াতুল হিদায়াহ, প্রকাশক: দারুল কিতাব, পৃ-১১৫]
“যখন কোনো শিশুকে দেখ, তখন বলবে–এই শিশু আল্লাহর কোন নাফরমানী করে নাই; কিন্তু আমি করেছি, অতএব, সে আমার চেয়ে ভাল। কোন বয়ঃবৃদ্ধ লোককে দেখে বলবে–এই ব্যক্তি আমার আগে থেকেই আল্লাহর বন্দেগী করে আসছে, অতএব, সে অবশ্যই আমার চেয়ে ভাল। যদি কোনো আলেম ব্যক্তিকে দেখ, তাহলে বলবে–সে যা কিছু পেয়েছে, আমি তা পাই নাই; সে যে মর্যাদায় পৌঁছেছে, আমি সেখানে পৌঁছাতে পারি নাই; সে বিদ্বান, আমি মূর্খ; তাহলে কি করে আমি তাঁর সমকক্ষ হতে পারি? যদি সে মূর্খ হয়, তাহলে বলবে–এই লোকটি না-ফরমানী করে থাকলে অজ্ঞতাবশতঃ করেছে, আর আমি আল্লাহর না-ফরমানী করেছি জেনে শুনে, সুতরাং আল্লাহর শাস্তি আমার ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য; আমি জানিনা, শেষ পরিণতি কার ভাল হয়; আমারই না তার। যদি তুমি কোন কাফির ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিপাত কর, তাহলে বল; আমি জানিনা, হয়তো বা সে মুসলমান হয়ে যাবে এবং তার জীবনাবসান নেক আমলের মধ্য দিয়ে হবে এবং ইসলাম গ্রহণের ওসীলায় তার সকল পূর্ব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে… আর আমি–খোদা না করুন–গোমরাহ হয়ে যেতে পারি, যার ফলে কুফর-শিরক ও পাপে লিপ্ত হয়ে আমার মৃত্যু হতে পারে; সুতরাং পরিণামে সে হয়তঃ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে আর আমি শাস্তি ভোগকারীদের দলভুক্ত হয়ে যাব।” [বিদায়াতুল হিদায়াহ, অনুবাদ: মুফতী মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ, প্রকাশক: দারুল কিতাব, পৃষ্ঠা ৯৫]
বইটির সম্পর্কে কিছু তথ্য:
নাম - বিদায়াতুল হিদায়াহ
লেখক - আবু হামিদ আল গাজ্জালী (রাহিমাহুল্লাহ)
অনুবাদক - মুফতি মুহাম্মদ উবায়দুল্লাহ
প্রকাশক - দারুল কিতাব, বাংলাবাজার।
মূল্য - ৪৫ টাকা মাত্র
পৃষ্ঠা সংখ্যা - ১২০