১৭ আগ, ২০১২

বিয়ের অপর নাম প্রশান্তি, উচ্ছ্বাস আর দয়া

কিশোর বয়স থেকে বিয়ের ব্যাপারে আমার একটা প্রশ্ন ছিলো মনে, সেই  প্রশ্নটা যাদের করেছিলাম, তাদের উত্তর কিছু খুবই নিম্নমানের। তাই আদতে আমার কৌতুহল নিবৃত্ত হয়নি। প্রশ্নটি ছিলো, দু'জন মোটামুটি অপরিচিত মানুষ কীভাবে সারাটা জীবন একসাথে কাটিয়ে দিতে পারে? মোটামুটি অপরিচিত বললাম এই কারণে যে, বিয়ের আগে থেকে আসলে তেমন একটা জানাজানি একদমই সম্ভব না। একসাথে থাকতে গেলে তখন টের পাওয়া যায় যে অনেকে অনেক ছোট-ছোট বিষয়েই বিরক্ত হয়। আর তার উপরে যখন একটা বয়স পরে অনেকের শরীরে রোগবালাই  ভর করে, তখন তো অপরজন অপার ভালোবাসায় আর যত্নে তার দেখাশোনা করেন -- এমনটাই বা কী করে সম্ভব?

অবশেষে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম। তাও পেয়েছি পবিত্র কুরআনুল কারীমের আয়াত থেকে। নুমান আলী খানের আলোচনা থেকে শেখা সেই আয়াতটির ব্যাখ্যা এখানে উল্লেখ করছি --


আল্লাহ বলছেনঃ

"আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে"।  [সূরা আর-রুমঃ ২১]

      
এই আয়াতটিতে আল্লাহ্‌ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অতুলনীয়, সংক্ষিপ্ত এবং সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে এই সম্পর্ককে তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) একটি নিদর্শন (আয়াত) বলে উল্লেখ করেছেন। আসুন এই পবিত্র সম্পর্ক সম্বন্ধে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা কি বলেছেন সেটা জানি। সম্পর্কটির বিভিন্ন পর্যায় তিনি তিনটি শব্দের দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন।


"..যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে (আরবি শব্দটি হচ্ছে - তাসকুনু) থাক..."

১) এই 'তাসকুনু' শব্দটির মূল হচ্ছে সুকুন । সুকুন = প্রশান্তি। 

যে কেউ ই তার ভালবাসার ব্যক্তির সাথে থাকার সময় প্রশান্তির এই অনুভূতি তীব্রভাবে অনুভব করে । আনন্দ, সন্তুষ্টি আর প্রশান্তির এই অনুভূতি স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি ভালবাসাকে আরো তীব্র ও গাঢ় করে তোলে। আর এই সুকুন এগিয়ে নিয়ে যায় সম্পর্কের দ্বিতীয় ধাপের দিকে।

সম্পর্কের প্রথম পর্যায়টি সুকুনের মাধ্যমে তুলে ধরার পর দ্বিতীয় পর্যায়টি বর্ণনা করেন এইভাবে:

"... তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন পারস্পরিক সম্প্রীতি (মাওয়াদ্দাহ)..."


২) মাওয়াদ্দাহ= গভীর আবেগের উচ্ছ্বাস মিশ্রিত ভালবাসা / কারো জন্য বা কোন কিছুর প্রতি তীব্র আকর্ষণ

অর্থাৎ, স্বামী বা স্ত্রী --

  • অপরজনের সাথে থাকার সময় প্রশান্তি অনুভব করে
  • তার প্রতি আবেগের উচ্ছ্বাস অনুভব করে

এভাবে  স্বামী স্ত্রীর এই যাত্রা যতই এগিয়ে যেতে থাকে আবেগের উচ্ছ্বাস ক্রমশ কমতে থাকে। দুজনেই আরো পরিণত হয় এবং তাদের কল্পনার স্বপ্নগুলো ফিকে হতে শুরু করে। এই পথচলায় অনিবার্যভাবেই কিছু বাধা-বিপত্তি আসে। প্রথম দিকে উভয়েই আবেগে অন্ধ থাকলে ও ধীরে ধীরে একে অপরের দোষ-ত্রুটিগুলো খুঁজে পেতে শুরু করে।

আল্লাহ্‌ আয়াতটিতে এরপরে বলেছেনঃ

"... এবং তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন দয়া (রাহমা)..."
 
৩) রাহমা = দয়া/ মমতা/ কোমল স্নেহময় ভালবাসা।

এখন সময়ের সাথে সাথে আবেগের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়তে শুরু করেছে এটা-সেটা নিয়ে খুনসুটি আর ঝগড়ার কারণে আগের সেই অখন্ড প্রশান্তি ও হয়ত সবসময় থাকেনা তাই আল্লাহ্‌ বললেন যে তিনি উভয়ের হৃদয়ে দিয়েছেন একে অপরের জন্য 'রাহমা' । যাতে করে মান-অভিমানে জড়িয়ে পড়লেও তারা যেন একে অপরকে গভীর মমতায় ক্ষমা করে দিতে পারে। এই 'রাহমা' ই সম্পর্কে এগিয়ে নিয়ে যায় কারণ যত কিছুই হোক না কেন বুকের গভীরে আমরা কখনোই চাইনা আমাদের ভালবাসার মানুষটা কষ্ট পাক।

আয়াতটির শেষে আল্লাহ বলেছেনঃ "... নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে"
সুবহানাল্লাহ !!

সুন্দর এই নিদর্শন নিয়ে আপনি চিন্তা করেছেন কি? এই অসাধারণ বাণী জানার পরে কোন মুসলিম-মুসলিমাহর উচিত নয়  'কেয়ারিং আর শেয়ারিং' এর নামে হারাম সম্পর্ক করতে যাওয়া বরং আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল করে বিয়েটা করেই ফেলা।

বিয়ে করার ব্যাপারে সবকিছুই প্রতিকূল খুঁজে পাচ্ছেন? এখন উপায়?

আল্লাহর নির্দেশ মানার নিয়াত করে হাত দু'খানি তুলে দুআ করে সাহায্য চাইতে পারেন। কোন কঠিন কিছুকে সহজ করে দেয়ার মালিক আল্লাহ। কিন্তু নিয়াত করার এবং দুআ করার কাজটা আমাদেরকেই করতে হবে।

কোন হারাম সম্পর্ক নয়, কোন হারাম দৃষ্টি নয়, হারাম কোন যোগাযোগ নয় ইনশাআল্লাহ। বরং চলমান সমাজের এইসব কলুষতাকে এড়িয়ে পবিত্র সম্পর্কটিতে দু'জনার সম্পর্কের প্রতিটি মূহুর্ত যেন ইবাদাত হয় সেই ইচ্ছা পোষণ করে দুআ করা দরকার। আল্লাহর দেওয়া সুকুন, মাওয়াদ্দাহ আর রাহমাহ অর্জনের অভিপ্রায় বুকে নিয়ে ক্রমাগত চাইতে থাকা উচিত। চাওয়ার আবেগ আর তীব্রতা বেশি থাকলে কেঁদে কেঁদে জায়নামাজ ভিজিয়ে ফেলে চাইতে হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত দু'আ শুনেন। আল্লাহ অবশ্যই সবকিছু সুন্দর, শান্তিময় আর সহজ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ, যদি তাঁর কাছে আমাদের চাওয়া হয় সুন্দর।

নিশ্চয়ই আল্লাহ এই বিশ্বজগতের প্রতিপালক, যিনি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী, যিনি হও বললেই হয়ে যায়, যিনি অসীম করুণাময়, পরম দয়ালু, যিনি আমাদের সমস্ত দুআ শোনেন। আমাদের রব আল্লাহর কাছে ছাড়া আমরা আর কার আছে যাবো? দু'হাত রিক্ত-শূণ্য আমরা চেয়ে চেয়েই একদিন সম্পদে পূর্ণ হয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। :)

আল্লাহ তা'আলা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেনঃ

"...যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে... " [সূরা বাকারাহ : ১৮৬]


প্রাসঙ্গিক লেখাঃ
 রেফারেন্স

৪টি মন্তব্য:

  1. এখানে যে উল্লেখ করা হয়েছে - '‘মাওয়াদ্দাহ’ পর্যায় সাধারণত দুই বছরের মতন স্থায়ী হয়। এই "দুই বছর" কে নির্ধারন করে দিল? এর পেছনে কি কোন কুরআন বা হাদীসের সনদ আছে? অনুগ্রহ করে জানাবেন।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ভাই আপনি তো নামটা বা ইমেইল জানান নাই, আপনাকে কীভাবে জানাব। যাহোক, নুমান আলী খান একটা আলোচনাতে এই কথাটা বলেছিলেন। কুরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা বলার সময় উনি মাওয়াদ্দাহ এর কথা বলেছিলেন, আর দুই বছরের আগে *সাধারণত* শব্দটি বলা হয়েছে। এর পেছনে কুরআন বা হাদিসের সনদ আছে কিনা তা আমি জানিনা। তবে এতটুকু বলতে পারি, মাওয়াদ্দাহ বলতে যে সময় বোঝানো হয়েছে, আমাদের বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে তা আদৌ দুই বছর থাকে বলে দেখিনা। বিবাহপূর্ব পরিচিতি থাকায় নারী বা পুরুষের আবেগ-উচ্ছ্বাসগুলো বিয়ের আগেই শেষ হয়ে যায়।

      লেখা পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

      মুছুন
    2. @ওয়াইল্ড চাইল্ড ভাইজান,

      আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ কষ্ট করে এই বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানানোর জন্য। এখানে সাইটেশন বা আনঅথেনটিক সোর্স নাই? আপনি লেখার নিচে রেফারেন্স সেকশন ঘাঁটলেই উপরের সমস্ত বিষয়াদি পরিষ্কার করে পেতেন। আপনি এই কাজটাই করেননি বোধহয় ভুল করে।

      আলোচনাটা উস্তাদ নুমান আলী খান করেছেন, সে ওয়েবসাইটের লিঙ্ক উপরেই দেয়া আছে। মাওয়াদ্দাহ কতদিন স্থায়ী হয় এখানে ভাষাটা দেখেছিলেন? -- *এই 'মাওয়াদ্দাহ' পর্যায় সাধারণত দুই বছরের মতন স্থায়ী হয়* এবং তার পরের আলোচনাটুকু পড়ে আপনার একটা বোধ আসার কথা ছিল। মাওয়াদ্দাহ কতদিন স্থায়ী হয়, এটা আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলনা, আর এই সময়টাও এখানে সেভাবে বলা হয়নি, তাছাড়া ইংরেজিটা পড়ে দেখতে পারেন, বাংলা করার সময় হয়ত প্রকৃত ভাবটা হালকা হয়ে গেছে। এই আয়াত নিয়ে আর যাই হোক, স্কলারদের মতভেদ আছে কিনা, সেইটা জানিনা, থাকার কথা না বলেই বুঝি কেননা প্রায়োগিক দিক থেকে এতে কোন সমস্যা নাই। যদি থেকেও থাকে, সেইটা আমার মতন অজস্র শিক্ষানবীসদের জন্য তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সমস্যা না বলেই বুঝি, এই পুরো অংশ পড়ে আমি সহ শত-শত পাঠকদের কেউই এই বিষয়টাতে হোঁচট খাননি। আলোচনার বিষয়বস্তু এবং ফোকাসই ব্যাখ্যার মূল বিষয় বলে বুঝি। আমার বুঝার সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, আল্লাহু আ'লাম।

      আপনি জ্ঞানের জন্য যেমন শুদ্ধবাদী, এটা খুবই সুন্দর গুনাবলী। আল্লাহ আপনাকে রহম করুন আর জ্ঞানকে বাড়িয়ে দিন, সেই জ্ঞান অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দিন।

      তবে, সবকিছু বিচার করেই আমার ভুল কিছু মনে হচ্ছেনা। আপনার কমেন্টের জন্য আরেকবার ধন্যবাদ ও শুকরিয়া জানাচ্ছি। আপনার মতন করে যারা চিন্তা করেন, আপনার কমেন্ট থেকে তারা লাভবান হবেন বলে আশা রাখছি। আসসালামু আলাইকুম।

      মুছুন
    3. আপনার আন্তরিক মন্তব্য পাওয়ার পর আমি কয়েকজন ভাইয়ের সাথে আলোচনা করেছি এই ব্যাপারটা নিয়ে। তারপর দুই বছরের কথাটা সরিয়ে দিয়েছি। মাওয়াদ্দাহ বলতে যেই সময়টাক বোঝানো হয়েছে, তা হয়ত কারো জীবনে আগেই হারিয়ে যেতে পারে, কারো হয়ত দীর্ঘসময় স্থায়ী হতে পারে -- এটুকু নিয়ে আমার যেমন সংশয় হয় বলে অনুবাদ করার সময়েও আমাদের কারো এটা নিয়ে চিন্তা হয়নি, খটকা লাগেনি। কিন্তু আপনি বলার পর এটার ভিন্ন একটা দৃষ্টিকোণ ও অর্থবাচকতা জানতে পেরেছি। সবকিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে সরিয়ে দিলাম। আল্লাহু আ'লাম।

      আরেকটা ব্যাপার হলো, এইটা কিন্তু কুরআনের ব্যাখ্যা না, এইটা আলোচকের মতামত ছিলো। উস্তাদ নুমান আলী খান একজন শ্রদ্ধেয় মানুষ, যার কাছে অনেক কিছু শিখছে সবাই, আর আমিও শিখেছি। তার নিয়্যাহ বা যোগ্যতা নিয়ে চিন্তা করা আমার মতন নাদানের জন্য বেমানান।আল্লাহ আমাদের কুরআনের জ্ঞান অর্জন এবং সেই অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দিন।

      মুছুন

আপনার মূল্যবান মতামত জানিয়ে যান লেখককে