শীর্ষেন্দুর বইয়ের প্রতি আমার একটা বিশেষ দুর্বলতা ছিলো -- সেটা পার্থিব পড়ে খুব বেশি মনে হয়েছিলো। ভাবনার গভীরে, চরিত্রগুলোর প্রতিটির চিন্তাধারাকে পাঠক হিসেবে এক্সপ্লোর করার ব্যাপারটা অত্যন্ত আনন্দের সাথে উপভোগ করতাম। চয়নের অনুভূতিগুলো যেন বুঝতে পারতাম, হেমাঙ্গের কথাও মনে হয় আজো। কী যেন নাম ছিলো মেয়েটার ঝিমলি নাকি অঞ্জলী আর একটা প্রবাসী মেয়েটা -- তাদের চরিত্রের স্বরূপগুলো অনুভব করতে পেরেছিলাম এটা মনে আছে। প্রায় বছর দশেক আগের স্মৃতি হিসবেও এই স্মৃতিচারণ মন্দ হলোনা!
যখন পড়া শেষ করলাম। তখন কৃষ্ণজীবন ছাড়া প্রায় সমস্ত চরিত্রের প্রতি অভক্তি চলে এসেছিলো। এমনকি এই লোকটাও বাচ্চা একটা মেয়ের প্রতি আকর্ষণবোধটাকে বুঝতে পারছিলেন, পাত্তা দিচ্ছিলেন। লেখক এই ''স্বরূপ''গুলোকে আমার মতন পাঠক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমি গ্রহণও করেছিলাম প্রায় পুরোটাই। কিন্তু বারবার অস্বস্তিতে পড়ছিলাম, আমার মন বলছিলো একটা লাস্ট ফিলিংস নিয়ে আমার বই বন্ধ করার দরকার। আমি পাইনি। যদিও এটাই ছিলো আমার পড়া, আর ভালোলাগা সেরা বইগুলোর একটা যাতে লেখকের সাথে দীর্ঘসময় একটা যাত্রা হয়েছিলো। কত পৃষ্ঠা যেন ছিলো, প্রায় হাজারের কাছাকাছি যতদূর মনে হয়...
এর প্রায় আধযুগ পরের কথা। যেদিন কায়সার ও কিসরা হাতে নিলাম নসীম হিযাযীর, সেদিন আমি দমবন্ধ করে পড়েছিলাম। একটানা -- একটানা। এই বইটার পাতায় পাতায় ছিলো আমার মুগ্ধতা। খুব বেশিদিন হয়নি, হয়ত আধযুগ। কিন্তু লেখক আমাকে উপহার দিলেন অদ্ভূত একদল অনুভূতি। আসেম নামের সেই ছেলেটার ত্যাগের কথা স্মরণ করে আমার চোখ ভিজেছিলো। সেই মেয়েটা -- কী যেন নাম -- সামিয়া বা সামিরা টাইপ কিছু, সে মরে যায়। আমার মনে হয়েছিলো মেয়েটা বোধহয় আমারই খুব কাছের কেউ। তারপর তার ক্রমাগত সত্য খোঁজার যাত্রা। ফুস্তিনা আর ইউসিবা নামের দুই মহিলাকে বিপদ থেকে উদ্ধার। এরপর আরও শত শত পৃষ্ঠার গল্প। তাতে ছিলো রোমান আর পার্সি সাম্রাজ্যের গল্প। ইতিহাস যেখানে অবিকৃত ছিলো। চরিত্রগুলো সেখানে অলংকার। চারিত্রিক মাধুর্যের গল্প, রোমান্টিসিজম ছিলো পুরোভাগেই, কিন্তু একচুল কোথাও অস্বস্তিতে পড়েছিলাম বলে মনে পড়েনা। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, যেদিন ''পূর্ব-পশ্চিম'' পড়ছিলাম সুনীলের, সেখানে প্রধান চরিত্রগুলোর একটি যখন তার বাসায় থাকা দূর সম্পর্কের বোনটিকে শারীরিক স্পর্শে ব্যাকুল হয়েছিলো -- তখন একদিকে অদ্ভূত একধরণের চাঞ্চল্য নিজের মাঝে, অন্যদিকে লজ্জায় বারবার তাকাচ্ছিলাম বড় ভাইয়ের দরজার দিকে -- মনে হচ্ছিলো ও হয়ত জেনে যাবে আমি এইসব বাজে জিনিস পড়ছি।
এই জায়গাগুলোতেই আমার অস্বস্তি লাগতো। আমি অবারিত শব্দপ্রয়োগে, শব্দচয়নে বিশ্বাসী নই। যেই শব্দগাঁথা আমাদের মনকে ভ্রষ্ট করে, সেই শব্দকে গাঁথা পাঠকপ্রজন্মকে গর্তে ঠেলে দেয়ার নামান্তর বলে মনে হয় আমার কাছে। বহু লেখকের রোগাক্রান্ত নীতিময় লেখার পড়ার পর নসীম হিযাযী আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন, উদ্দীপনা দিয়েছিলেন -- সুন্দর অনুভূতিরা সুন্দরই থাকে। চাওয়া আর আকাঙ্ক্ষা-কামনাদেরও সুন্দর রূপ থাকে। যেটা নিয়ে সন্দেহের জালে পড়েছিলাম শীর্ষেন্দু আর সুনীলের কাছে। সেই সাহিত্যের প্রভাবে আমার চিন্তাচেতনায় প্রভাব কতখানি ছিলো তা কেবল আমি জানি। চিন্তার এই স্বরূপগুলো আগে বুঝতে পারিনি -- ইদানিং পারি। এই অল্প অপপ্রভাবটুকু জীবনে অনেক ক্ষতি এনে দিতে পারে -- এনে দেয়। শুধুই নৈতিক শিক্ষা সম্পন্ন, আর না থাকা দুইটি লেখাতে যোজন যোজন দুরত্ব। এখানে অবশ্য বয়েসের একটা ব্যাপার থাকে। একটা নির্দিষ্ট বয়েসে অনেক কিছুই গা সওয়া আর স্বাভাবিক, যা কৈশোরের জন্য না। যাহোক, আমার লেখাতে আমি সেই বিষয়টা নিয়ে তর্ক বা সমালোচনা করতে বসিনি। আমি লিখছি কেবল দুটো জিনিসের কিছু পার্থক্য দেখাতে।
আমি অনেক লিখেছি জীবনে -- পত্রিকায়, এখানে ওখানে। কিন্তু এখন একটা জিনিস মনে হয় -- আমি কেন লিখি? আমার এই লেখাগুলোর একটা অর্থ থাকা জরুরী। যেখানে জীবনটা অর্থহীন নয়, সেখানে অর্থ থাকা আবশ্যক। লেখালেখি কাজটা খেলো না। এইটা সবাই পারেও না। এইটা অর্জন। আর এই অর্জন যখন ধূলোয় লুণ্ঠিত হবে, সেটা কষ্টকর। নিঃসন্দেহে প্রতিটি কাজেরই হিসেব দিতে হবে। যখন আমাকে বলা হবে -- তোমার এই লেখাতে কতজন পথভ্রষ্ট হয়েছে জানো? ... অথবা তোমার এতখানি সময় নষ্ট করে তোমাকে দেয়া দাসত্বের কতখানি পালন করেছ তুমি? এইসময় শূণ্য থাকতে কেউই চাইনা আমরা -- যারা বিশ্বাস করি আমাদের মালিক, সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার দাস আমরা।
নসীম হিযাযীর হেজাজের কাফেলা, খুন রাঙ্গা পথ, আঁধার রাতের মুসাফির, সীমান্ত ঈগল পড়ে আমার শত-সহস্রবার মনে হয়েছে, এমন সাহিত্যিক অনেক বেশি থাকতে পারতো। এই রঙ্গে রঙ্গিন অনেকেই থাকতে পারত। যেই লেখা পড়ে মনে হয় চরিত্রটা আমার সুন্দর করা প্রয়োজন। আমার সত্যবাদী হওয়া দরকার, দ্বায়িত্ববান হওয়া দরকার। আমার মনে হতো এই জীবনের পরেও আরেকটা জগত আছে, যেখানে কিছু নিয়ে যাওয়াই এই জীবনের চেতনা।
হতে পারে সেটা আমাদের রোজনামচা। হোক সেটা একজন দাসের লেখা। হতে পারে সেটা অর্থনীতির উপর লেখা-- সেখানে থাকুক একজন দাসের দাসত্বের ছাপ -- যেখানে তার প্রভূ তাকে নির্দেশ আর আদেশ দিয়েছেন কিছু -- যার আলোকে তার এই কাজ। হতে পারে সেটা গল্প -- সেখানে থাকুক নীতির বাইরে না যাওয়ার প্রেরণা -- আগুণের আহবান সেখানে যেন না থাকে। যদিবা চরিত্রগুলোকে নীচ কোন কিছুতে ইনভলভড দেখানোও লাগে -- সেটা যেন পাঠকের কাছে নীচ ভাষায় না যায় -- যেন শেষ টুইস্টটা থাকে সত্যের পথের দিকে এগিয়ে যাওয়ার।
দাসের আচরণ আর কেমন হতে পারে? দাসের সৃষ্টি কেন প্রভূর কথার বাইরে হবে? তাইতো এই সাহিত্য মানেই পথভ্রষ্টতা নয়। চোখের সামনের পাঠ্যে হয়ত ৯৮ শতাংশ ভ্রষ্টকথা -- তবু মনে রাখা দরকার -- এই সৃষ্টিশীলতা যেন সীমাহীন উত্তাপের দিকে নিয়ে না যায়। কেননা, একদম সবকিছুর শেষে কেবল দুটি জিনিসই থাকবে -- প্রশান্তি, আর উত্তাপ।
জুন ২০১১