১২ অক্টো, ২০১১

অনিবার্য সেই সময়ের প্রতীক্ষায়

পড়ছিলাম একটা কবিতা। সেদিন হঠাৎই কবিতাটা সামনে পেলাম। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। কবিতার প্রতিটা ছত্রে-ছত্রে যেই ছবি, তা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো যেন! এই বিশাল সভ্যতা এগিয়ে যাবে আরো অনেকদূরে। থ্রি-জি, ফোর-জি ছাড়িয়ে হয়ত দশম জেনারেশনে পৌঁছে যাবে মোবাইল কমিউনিকেশন। জ্ঞানের এই বেগবান ধারা নিমেষেই আমাদের জীবনকে করে দেবে বিলাসবহুল।


নিউজার্সি, টেক্সাস, প্যারিস, লন্ডন, শিকাগো, ক্যানবেরা, জেনেভা কেন্দ্রিক এই পৃথিবীতে আমাদের চলাচলের যান হবে ইচ্ছে হলেই টেক অফ করবে এমন এক 'অটোকার'| ত্রিমাত্রিক অবয়বের মানুষটির চিত্র এসেই সামনে বা পাশে বসে কথা বলবে মোবাইল ফোন অন করার সাথে সাথে। সুশোভিত হবে কল্পনাকে ছাড়িয়ে চলে এই সভ্যতার। সেই সাথে সেখানে থাকবে অবর্ণনীয় কষ্টে থাকা মানুষ। দু'বেলা খেতে পাবেনা তারা। যেভাবেই হোক বড়লোক হবার প্রবল আগ্রহে ছুটে চলা মানুষরা কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কয়না এখনই। ভোগ করতে চাওয়ার প্রবল আগ্রহে অন্যকে ঠকিয়ে, সুদ-ঘুষে জমানো টাকা দিয়ে গার্মেন্টসের মালিক -- যিনি গাড়ি কিনে স্ত্রী সন্তান নিয়ে 'আউটিং' এ যাওয়া হাসমত সাহেব একদিন ধুম করে টিপু মাস্তানের গুলিতে মরে যাবে। ভোগের প্রবল স্বপ্নে কখনই সময়মত ফিরতে না পারা হাসমত সাহেবের ছেলেটা কৈশোরেই 'টাইমপাস' করতে বান্ধবী আর নেশার মাঝে আটকে গেছে তা জানবেনও না। এক অনিবার্য পরিণতিতেই সন্তানের হাতে শূণ্য হবে ''হাসমত গার্মেণ্টস এন্ড ডাইং''।

কাউকে ঠকিয়ে বড়লোক হলে দারিদ্রের সীমানার নিচে থাকা খুপড়ির ঘরের ছেলেটা কীভাবে চেয়ে চেয়ে সহ্য করবে সামনের রাস্তার পার্লারে লিসা আর সিমি হাজার হাজার টাকা দিয়ে পার্লারে ত্বক আর চুলের যত্নেই কাটিয়ে যাচ্ছে দিনের অনেক সময়। এই ক্রমঃবর্ধমান ব্যবধানই একটা অবধারিত সময়ের দিয়ে বয়ে নিয়ে যাবে।

পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ নিয়ে "দিলাম কিন্তু, দিলাম!" টাইপের হুমকি দিতে থাকবে তেলের স্বপ্নে বিভোর মার্কিনরা। পাচাটা কুত্তার দল ফ্রান্স আর বৃটিশরাও এগিয়ে যাবে এই পথে। ক্রমশ স্বাস্থ্য হুমকি বাড়তেই থাকবে আফ্রিকায়। আমেরিকার ওষুধ পরীক্ষার গিনিপিগ যেই জাতিগুলো -- তাদের প্রতিবন্ধী প্রজন্মই ছিঁড়েখুড়ে খেয়ে ফেলবে জাস্টিন বিবারদের উন্মত্ত প্রজন্মকে। শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতিকে মেনে চলে শত শত লাইনের ইকুএশন ডিরাইভ করা মানব সম্প্রদায় যখন একটুও ভাবে না এই ভোগেরও সংরক্ষণশীলতা নীতি থাকতে পারে। আজ আমার ভোগ করতে যদি কাউকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় -- সেই ফলটা আমার কাছেই ফিরে আসবে। এক অনিবার্য বিপ্লবেরই একটি অনুচ্ছেদ সৃষ্টি করবে।


মনের ভিতরের বিবেককে ভারতের মায়েদের উদরে আভাসিত হওয়া কন্যাশিশুগুলোকে ভ্রুণে হত্যার মতন করে হত্যা করছি আমরা এই ''মানুষেরাই''! এক অস্থির ভোগের, বিলাসের, সম্পদ অর্জন আর ক্যারিয়ারকে অন্ধ স্বপ্ন বানিয়ে ছুটে চলেছি আমরাই এক নিঃশেষ হাইওয়ের পথে। যখন পথে রাস্তা পার হচ্ছিলাম পকেটে আইপড অথবা নোকিয়া ই-সিরিজের ফোনের হেডসেট কানে লাগিয়ে ''মাই নেম ইজ শিলা, শিলা কি জওয়ানি'' শুনতে শুনতে, তখন রাস্তার পাশে জহির আর লিটনদের পকেটে নেই একটা ডালপুরি খাওয়ার টাকাটাও। এরকম শত-সহস্র দৃশ্যাবলী -- সেও হয়ত এক অনিবার্য পরিণতিরই প্রতীকমাত্র।

তবু সবসময়েই জগতে ছিলো সুন্দর মনের মানুষ। যাদের বুকের আধহাত চওড়া জায়গার ভেতরে পুতি-দুর্গন্ধময় কালো আত্মা না-- বরং ধবধবে শুভ্র আত্মা লুকিয়ে আছে। যারা কারো চোখে অশ্রু দেখলে নিজের হাতেরটা দিয়ে তাকে নিবৃত্ত করতে কুন্ঠাবোধ করেন না। তবু এমন অনেক তারিক, গালিব, মির্জাদের মতন ছেলে আছে যারা  নিজের আয়াশের অনেককিছু বিসর্জন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চায় আম্মু-আব্বুর জন্য স্পর্শ নিয়ে হাসিমাখা মুখ দেখতে। এমন অনেক তারুণ্যভরা ছেলে আজো আছে, যারা দলবেঁধে ছুটে যেতে চায় কষ্টে থাকা মানুষদের সাথে ভালোথাকা ভাগাভাগি করে নিতে। ঘামে মাখা রিকশাওয়ালার হাতের স্পর্শের প্রতি তাদের অশুচি উবে যায় হাসিমাখে প্রশান্তির ছায়াভরা মুখপানে চেয়ে।

এমন অনেক আত্মা আজো আছে, যারা ভূমিকম্প আর ঝড়ে ভয় পেয়ে নীল হয়ে যায়না -- তারা জানে এই অনিবার্য পরিণতি এসেই পড়ে --তারা ফিরে যাবে তাদের প্রিয়তম স্রষ্টার কাছে, যার কাছে যাওয়ার প্রেরণাই তাদের এই অল্প ক'বছরের জীবনের ক্ষুদ্রতা আর ভোগ থেকে মুক্ত থাকার উজ্জীবনী শক্তি। একদিন নিশ্চয়ই সব শেষ হয়ে যাবে। সেই অনিবার্য বিপ্লবের ইশতিহার পড়েছি কবি আসাদ বিন হাফিসের কবিতায়। অচেনা অজানা এই কবির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই যার লেখনী আমার বরফ শীতল অনুভূতিগুলোকে শীতল প্রস্রবণে পরিণত করেছে।

****************

আমি আমার জনগণকে আরেকটি অনিবার্য বিপ্লবের জন্য
প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেভাবে রুখে দাঁড়ায় আক্রান্ত দুর্বল
বিধ্বস্ত জাহাজ যাত্রীরা আঁকড়ে ধরে ভাসমান পাটাতন
তেমনি একাগ্রতা নিয়ে
আমি আপনাদেরকে আসন্ন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি।
বিপ্লব মানেই যুদ্ধ
বিপ্লব মানে তিল তিল বাঁচতে শেখা
বিপ্লব মানে ভাসমান রক্তপদ্ম, প্রস্ফুটিত কৃষ্ণচূড়া
বিপ্লব মানে জীবন
বিপ্লব মানে জীবনের জন্য আমরণ লড়াই।
আমি আপনাদেরকে আরেকটি অনিবার্য বিপ্লবের জন্য
প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি।
যে বিপ্লবে প্রতিটি নাগরিকের জীবন হয়
একেকজন যোদ্ধার জীবন
প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি মানুষ হয়
একেকজন আমূল বিপ্লবী
প্রতিটি যুবক
নারীর বাহুর পরিবর্তে স্বপ্ন দেখে উত্তপ্ত মেশিনগানের
আর রমণীরা
সুগন্ধি রুমালের পরিবর্তে পুরুষের হাতে তুলে দেয়
বুলেট, গ্রেনেড।
আমি আমার জনগণকে
আনিবার্য সেই বিপ্লবের জন্য
প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি।
বিপ্লব মানেই যুদ্ধ
বিপ্লব মানেই সংগ্রাম, সংঘাত
বিপ্লব মানে শিরায় শিরায় উদ্দাম ঝড়
ঝড়ো হাওয়া, টর্নেডো, সাইক্লোন
বিপ্লব মানে কল্লোলিত সমুদ্রের শোঁ শোঁ অশান্ত গর্জন
বিপ্লব মানে আশা, সফলতা ও বিজয়ের আমোঘ পুস্পমাল্য।
আমি আপনাদেরকে আরেকটি
অনিবার্য বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি।
যে বিপ্লব সাধিত হলে
মানুষের শরীর থেকে খসে পড়ে শয়তানের লেবাস
জল্লাদের অশান্ত চিত্তে জন্ম নেয় বসরাই গোলাপ
অর্ধ পৃথিবীর দুর্দান্ত শাসক
কেঁপে উঠে ফোরাত কূলের কোন
অনাহারী কুকুরের আহার্য চিন্তায়।
যে বিপ্লব সাধিত হলে
কন্যা হন্তারক অভাবী পিতাদের জন্য পরওয়ারদিগার
খুলে দেন রহমতের সব ক’টি বন্ধ দুয়ার।
তখন কোন অভাব আর অভাব থাকে না
উদ্বৃত্ত সম্পদ প্রদানের জন্য
পাওয়া যায় না কোন ক্ষুধাতুর বনি আদম।
অন্ধকার যত ঘনীভূত হয় ততই উজ্জ্বল হয় বিপ্লবের সম্ভাবনা
একটি কৃষ্ণ অন্ধকার মানেই
সামনে অপেক্ষমান একটি প্রস্ফুটিত সূর্যদয়
একটি আরক্ত সন্ধ্যা মানেই
বেগমান বোরাক চেপে ধেয়ে আসছে কোন কুসুম সকাল
একটি কৃষ্ণ মধ্যরাত মানেই
তার উল্টো পিঠে বসে আছে কোন মৌমাছি দুপুর
একটি মিথ্যা মানেই
তাকে ধাওয়া করছে কোন দ্রুতগামী সত্যাস্ত্র
একটি অবাধ্য সমাজ মানেই
সামনে নূহের প্লাবন, অনাগত ধ্বংস
আরেকটি নতুন সভ্যতার আমূল উদ্বোধন।
আমি আপনাদেরকে সেই
অনিবার্য বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি।
দিন রাত্রির প্রতিটি আবর্তনে
শোনা যায় যে বিপ্লবের অশ্বখুরধ্বনি
ঋতুচক্রের প্রতিটি আবর্তনে
শোনা যায় যে বিপ্লবের অশ্বখুরধ্বনি
মাস ও বছরের প্রতিটি ঘূর্ণিপাকে
শোনা যায় যে বিপ্লবের অশ্বখুরধ্বনি
যুগ ও কালের প্রতিটি ঘূর্ণিপাকে
শোনা যায় যে বিপ্লবের অশ্বখুরধ্বনি
শতাব্দীর প্রতিটি পরতে পরতে যে বিপ্লবের পলিময় মৃত্তিকা।
আমি আমার জনগনকে
সারাক্ষণ বুকের মধ্যে বিপ্লবের চাষ করতে বলছি।
যে বিপ্লবের চাষ করলে
প্রজ্জ্বলিত অগ্নি হয় জাফরান বীথি
যে বিপ্লবের চাষ করলে
নীল নদের আহার্য হয় অবাধ্য ফারাও
আবরাহার হাতি হয় পাখির খোরাক
চুরমার হয়ে যায় রোম ও পারস্যের
বিশাল সালতানাতের দাম্ভিক চূড়া
ব্যর্থ হয়ে যায় কারুনের ধন
কল্পিত স্বর্গদ্বারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে
অবাধ্য সাদ্দামের দশটি আঙ্গুল।
আর কারাগারের বন্ধি কয়েদী ইউসুফ
কুদরতের ইশারায় রাজমুকুট পড়ে হয়ে যান বাদশা কেনান।
আমি আমার জনগণকে
আসন্ন সেই বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
যেখানে অন্ধকার
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে ক্লেদাক্ত পাপ ও পঙ্কিলতার সয়লাব
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে নগ্নতা ও বেহায়াপনার যুগল উল্লাস
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে মিথ্যার ফানুস
সেখানেই বিপ্লব
বিপ্লব সকল জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে
বিপ্লব অন্তরের প্রতিটি কুচিন্তা আর কুকর্মের বিরুদ্ধে।
আমি আপনাদের সকলকে
বিপ্লবের মৌসুমের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
মৌসুম ছাড়া কোন বসন্ত আসে না
মৌসুম ছাড়া ফোটে না কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুল
সময়কে ধারণ করতে না পারলে গর্ভবতী হয় না কোন রমণী
ফলবতী হয় না সবুজ ধানের শীষ
সীম আর মটর দানা
সময়কে ধারণ করতে না পারলে সফল হয় না বিপ্লবের আরাধ্য কাজ।
কৃষ্ণ মধ্যরাত পেরিয়ে আজ বিংশ শতাব্দী ছুটছে প্রত্যুষের দিকে
সাইবেরিয়ার বরফ খন্ডে মুখ লুকাচ্ছে পাশবতন্ত্র
আ’দ ও সামুদ জাতির মত টেক্সাসের ঘোড়াগুলোকে
ঘিরে ফেলেছে আল্লাহর গজব
ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, বসনিয়া, কাশ্মীর,
পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তরে
লাউড স্পিকারের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে যুগের মুয়াজ্জিন
আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে এখনি আজান হবে
সে আওয়াজের নিচে হারিয়ে যাবে
এটম ও কামানের ধ্বনি
গড়িয়ে যাওয়া অজুর পানিতে ভিজে অকেজো হয়ে পড়বে
সব ক’টি দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র।
আবাবিল পাখির ঝাক গিলে খাবে আকাশ ফড়িং
রাজহাঁসগুলো
শামুকের পরিবর্তে গিলে খাবে জীবন্ত টর্পেডো
সাদা কবুতরের পাখনায় আটকা পড়ে
থেমে যাবে আনবিক ঝড়
আর বেহেশত থেকে শহীদেরা
আপনাদের বিজয় অভিনন্দন জানানোর জন্য
মার্চপাষ্ট করতে করতে
এসে দাঁড়িয়ে যাবে রাস্তার দু’পাশে।
তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকবে একটি করে রক্ত গোলাপ
সজীব ও তরতাজা
চিত্তহারী ঘ্রাণময়
আমি আপনাদেরকে সেই
অনিবার্য বিপ্লবের
পতাকা উত্তোলনের উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।

  • কবিতার নামঃ এক অনিবার্য বিপ্লবের ইশতিহার
  • কবিঃ আসাদ বিন হাফিজ
@ মে, ২০১১